ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রিড বিপর্যয়

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:১৫, ৫ অক্টোবর ২০২২

গ্রিড বিপর্যয়

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ৭ ঘণ্টা পর বিদ্যুত

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ৭ ঘণ্টা পর ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুত আসতে শুরু করে। ঢাকার বাইরেও বহু এলাকায় বিদ্যুত চলে আসে। রাত ১১টার পর বিদ্যুত পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে। তবে পুরোপুরি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত না পাওয়ায় কিছুটা লোডশেডিং করে বিদ্যুত পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়।  সবশেষ বিদ্যুত রিস্টোর হয়েছে মগবাজার, মাদারটেক, রামপুরা, গুলশান, উলন, বসুন্ধরা, ধানমণ্ডি, আফতাবনগর, রামপুরা, বনশ্রীসহ বেশকিছু এলাকায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্যুত আসার এমন খবর জানাচ্ছেন অনেকেই। বিদ্যুত সরবরাহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মঙ্গলবার রাত পৌনে ৯টার দিকে মিরপুর, মগবাজার, মাদারটেক, রামপুরা, গুলশান, উলন, বসুন্ধরা, ধানম-ি, আফতাবনগর, বনশ্রী, আদাবর, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও, মিন্টো রোড, মতিঝিল, শ্যামপুর, পাগলা, পোস্তগোলাসহ বেশকিছু এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এর আগে মিরপুর, এয়ারপোর্ট, গুলশান, বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোন এবং টঙ্গী এলাকায় আংশিকভাবে বিদ্যুত সরবরাহ সচল হয় বলে জানায় মন্ত্রণালয়। এছাড়া দেশের অর্ধেক এলাকায় বিদ্যুতহীন দশা শুরুর ৪ ঘণ্টা পর টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, মানিকগঞ্জে বিদ্যুত সরবরাহ সচল হওয়ার কথা জানান বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
মঙ্গলবার দুপুরে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আরেকটি বড় গ্রিড বিপর্যয়ের কবলে পড়ে দেশ। জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চল অংশে এ বিপর্যয়ের কারণে প্রায় অর্ধদিবসেরও বেশি সময় বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে রাজধানী ঢাকাসহ সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহের সব জেলা। এতে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শিল্পোৎপাদন বিঘ্নিত হওয়াসহ তীব্র গরমে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষজনকে। এমনকি সরবরাহ না থাকায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়।

বিদ্যুত বিপর্যয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিঘ্ন ঘটেছে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে। বিকল্প ব্যবস্থায় হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষের। এতে করে দুর্ভোগ পোহাতে হয় বিভিন্ন হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের। সন্ধ্যার পর ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে পতিত হয়। গার্মেন্টস কারখানা ও কিছু ফ্ল্যাট বাড়িতে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের জোগান দিতে গিয়ে পেট্রোল পাম্পগুলোতে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।
এ ঘটনা অনুসন্ধানে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিদ্যুত বিভাগকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, বিদ্যুত বিভাগের একটি এবং তৃতীয়পক্ষের একটি কমিটি বিভ্রাটের কারণ খুঁজে বের করতে কাজ করবে।

এছাড়া বিদ্যুতহীন পরিস্থিতিতে সারাদেশের পূজাম-পগুলোতে বাড়তি সতর্কতা জারি করেছে পুলিশ। দেশের সড়ক, মহাসড়ক ও বাসাবাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়। সড়কে সিসি ক্যামেরা ও গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে জেনারেটরের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাজধানীসহ পুলিশের প্রতিটি মেট্রোপলিটন এলাকায় টহল বাড়ানো হয়।
মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞাপ্তিতে বিদ্যুত বিভাগ এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে জানায়, আকস্মিকভাবে দুপুর ২টা ৪ মিনিটে জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলীয় অংশে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ) সমস্যা দেখা দেয়ায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে বিদ্যুত বিভ্রাট চলছে। পিজিসিবির প্রকৌশলীরা দ্রুততার সঙ্গে জাতীয় গ্রিড সচল করতে নিবিড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিদ্যুত সেবা চালু করা হবে বলে আশা করে বিজ্ঞাপ্তিতে বলা হয়, পিজিসিবিসহ বিদ্যুত খাতের সব সংস্থা একযোগে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধৈর্য ধারণ করতে বিনীতভাবে অনুরোধও জানানো হয়।
তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সিলেট বিভাগের কিছু অংশ এবং ঢাকার কয়েকটি জেলা ছাড়া অন্য কোথাও বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিবি) সূত্র জানায়, গ্রিড ট্রিপ করেছে, সমাধানে কাজ চলছে। কতক্ষণ এমন পরিস্থিতি চলবে বলা যাচ্ছে না।
পিজিসিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা বদরুদ্দোজা সুমন জানান, যমুনার এ পাড়ের (দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের) জেলাগুলোতে বিদ্যুত বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কোন কোন জেলা রয়েছে, তা এখনও সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি।
এদিকে ঢাকায় বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান সাংবাদিক জানান, দুপুর ২টার দিকে বিদ্যুত বিপর্যয়ের এ ঘটনা ঘটে। আমাদের বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছে। সমস্যা সমাধানে পিজিসিবি চেষ্টা করছে বলে আমাদের জানিয়েছে। এই মুহূর্তে ঢাকা শহরের প্রায় সব জায়গাই বিদ্যুতবিহীন।
এদিকে এই সঙ্কটে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং রাষ্ট্রপতি ভবনেও বিকল্প উপায়ে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক (জনসংযোগ) শামিম হাসান বলেন, ত্রুটি এখনও আমরা সুনির্দিষ্ট করতে পারিনি। তবে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুত রিস্টোর করা হচ্ছে। সিলেটের কয়েকটি জায়গায় বিদ্যুত এসেছে। এদিকে গাজীপুরের টঙ্গী পর্যন্ত কিছু এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ শুরু হয়েছে।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মোবাইলের নেটওয়ার্কে তৈরি হয় জটিলতা। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) এক বিবৃতিতে এজন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, জাতীয় বিদ্যুত গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাময়িক সময়ের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা বিঘিœত হতে পারে। এ পরিস্থিতির জন্য আমরা দুঃখিত।
ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি ইমদাদুল হক সাংবাদিকদের জানান, জেনারেটর দিয়ে পপ চালু করলেও ব্যবহারকারী পর্যায়ে বিদ্যুত না থাকায় ব্যান্ডউইথ ব্যবহার ৮০ শতাংশ কমে গেছে।
সূত্র বলছে, বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হলে মোবাইল টাওয়ারগুলো জেনারেটর দিয়ে ২-৫ ঘণ্টা চালু রাখা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় বিদ্যুত না থাকলে জেনারেটর দিয়েও এর কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয় না।
এদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানিয়েছেন, আমিন বাজার গ্রিড পর্যন্ত বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে রাত ৮টার মধ্যে ঢাকা শহরের সব এলাকা এবং তারপর ৯টার মধ্যে চট্টগ্রামের সব এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। পাওয়ার গ্রিডের ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ানরা কাজ করছেন। গুজব না ছড়িয়ে সবার প্রতি একটু ধৈর্য ধরার অনুরোধও করেন তিনি।
এদিকে দীর্ঘসময় বিদ্যুত না থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় হাসপাতালের রোগীদের। বিদ্যুত না থাকায় রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক), সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক করার চেষ্টা হলেও তা বেশিক্ষণ চালু রাখা সম্ভব হয়নি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থায় চলে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)।
সরেজমিনে দেখা যায়, গাইবান্ধা থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আফসানা বেগম ভর্তি আছেন নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে। তার অবস্থা খুবই খারাপ সিটি স্ক্যান করাতে বলেছেন চিকিৎসক। কিন্তু বিদ্যুত না থাকায় সিটি স্ক্যানের সামনে কয়েক ঘণ্টা ধরে টলিতে পড়ে আছেন। কখন বিদ্যুত আসবে কেউ কিছুই বলতে পারছেন না।
হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে বিদ্যুত না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা। হাতপাখা দিয়ে রোগীকে বাতাস করছেন রোগীর স্বজনরা। কখন বিদ্যুত আসবে সেটা নিয়ে নার্স, ওয়ার্ড বয় ও নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে জানতে চাচ্ছেন রোগীর স্বজনরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোর) ডাঃ আশরাফুল আলম বলেন, জরুরী যেখানে দরকার সেখানে আমরা জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। জরুরী ভিত্তিতে আইসিইউ ও ওটিতে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই জেনারেটর টানা ১২ ঘণ্টা চলবে। প্রত্যেক ভবনের জন্য আলাদা জেনারেটর ব্যবস্থা আছে বলে জানান তিনি।
বিশাল এই বিপর্যয় নিয়ে আনুষ্ঠানিভাবে কথা না বললেও জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিদ্যুত বিভাগকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু মঙ্গলবার বিকেলে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সাংবাদিকদের জানান, বিদ্যুত বিভাগের একটি এবং তৃতীয়পক্ষের একটি কমিটি বিভ্রাটের কারণ খুঁজে বের করতে কাজ করবে।
মন্ত্রণালয়ের ধৈর্য ধরার অনুরোধ ॥ এর আগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারাদেশে বিদ্যুত সরবরাহ চালু হবে জানিয়ে দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানায় বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ অনুরোধ জানানো হয়।
পোস্টে বলা হয়, ‘আকস্মিকভাবে দুপুর ২টা ৪ মিনিটে জাতীয় গ্রিডের ইস্টার্ন অংশে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ) সমস্যা দেখা দেয়ায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে বিদ্যুত বিভ্রাট চলছে। পিজিসিবির প্রকৌশলীরা দ্রুততার সঙ্গে জাতীয় গ্রিড সচল করতে নিবিড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিদ্যুত সেবা চালু করা হবে বলে আশা করা যায়।’
এতে আরও বলা হয়, ‘পিজিসিবিসহ বিদ্যুত খাতের সব সংস্থা একযোগে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে বিনীতভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে।’
অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলেছেন,
মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই বিদ্যুত সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে বিদ্যুত রিস্টোর হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ আগেই সিদ্ধিরগঞ্জ ও ঘোড়াশালের কিছু এলাকায় এবং ঢাকার বঙ্গভবনে বিদ্যুত রিস্টোর হয়েছে। ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় স্বাভাবিক হবে কিছু সময়ের মধ্যেই।’
এর আগে অপর এক পোস্টে তিনি বলেছিলেন, ‘আমিনবাজার গ্রিড পর্যন্ত বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। রাত ৮টার মধ্যে ঢাকা শহরের সব এলাকা এবং রাত ৯টার মধ্যে চট্টগ্রামের সব এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।’
হাসপাতালে ভোগান্তি ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ, ওটিসহ সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করা আছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে বিদ্যুত না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগীরা। শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা ৬ মাস বয়সী ছেলে ফাহিমকে নিয়ে গত সোমবার আনোয়ারা থেকে চমেকে আনেন ফাতেমা বেগম।

হাসপাতালের শিশু মেডিসিন ওয়ার্ডে তার চিকিৎসা চলছে। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর ২টা থেকে বিদ্যুত না থাকায় শিশুটিকে নেবুলাইজ করা যাচ্ছিল না। ফাতেমা বেগম বলেন, ‘দিনে ৪ বার নেবুলাইজ করতেন চিকিৎসক। কিন্তু দুপুর থেকে নেবুলাইজার চালানো যাচ্ছে না। কারণ বিদ্যুত নেই।’
জানা যায়, জেনারেটরের সাহায্যে সীমিত আকারে বিদ্যুত সরবরাহ করা হলেও সার্বিকভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুত না থাকায় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে কয়েকটি ওয়ার্ডে। জেনারেটরের সাহায্যে সীমিত আকারে বিদ্যুত সরবরাহ করা হলেও বিভিন্ন ওয়ার্ডের দু’একটি বৈদ্যুতিক বাতি ছাড়া পাখা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। এমনকি নেবুলাইজার মেশিন চালানোর সকেটও বন্ধ রাখা হয়।
প্রতিটি ওয়ার্ডে গরমে রোগীরা দুর্ভোগে পড়েছে। তাদের হাতপাখা বা বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে বাতাস করছেন স্বজনরা। ওয়ার্ডে দু-একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বললেও পর্যাপ্ত আলো ছিল না। হাসপাতালের বাথরুমে পানি বন্ধ হয়ে গেছে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত ॥ জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিদ্যুত না থাকায় ৩০ মিনিটের জন্য ইমিগ্রেশন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এক পর্যায়ে অধিকাংশ এসি বন্ধ রেখে জেনারেটর চালু করে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম সচল করা হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জেনারেটরের মাধ্যমে চলছিল শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম। বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, দুপুর সোয়া ২টা থেকে সোয়া ৩টা পর্যন্ত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যুত সেবা বন্ধ ছিল। বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনাসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। পরে বিশেষ ব্যবস্থায় বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক করা হয়েছে।
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যুত বিপর্যয়ের পর জেনারেটর দিয়ে বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। ইনশাআল্লাহ জেনারেটর দিয়ে যথেষ্ট সময় চালাতে পারব।’
মোবাইল নেটওয়ার্কে বিঘœ ॥ জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে (যমুনা নদীর এপার) বিদ্যুত বিপর্যয় হওয়ায় বিদ্যুতবিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিক রাখতে বিকল্পব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবুও কোথায়ও কোথায়ও মোবাইল ডাটায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিদ্যুতবিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে মোবাইলে কথা বলতে গেলে কলড্রপও হচ্ছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, ‘এটা জাতীয় বিপর্যয়। নেটওয়ার্ক সচল রাখতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’
এরই মধ্যে ১ হাজার বিটিএস (বেস ট্রান্সিভার স্টেশন) ক্রিটিক্যালি এ্যাফেক্টড হয়েছে। জেনারেটর দিয়ে যতটুকু সম্ভব ব্যাকআপ দেয়ার চেষ্টা চলছে। আমি প্রতিনিয়ত অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সম্মিলিতভাবে এ বিপর্যয়ে সেবা সচল রাখার চেষ্টা করছি।
অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুত সমস্যায় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়ে ৩৩ হাজার টাওয়ার ও বিটিএস। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ১২ হাজার, রবির ১১ হাজার এবং বাংলালিংকের ৯ হাজার সাইটে রয়েছে। কেননা ঢাকার বাইরের বিটিএসগুলো সাধারণত দু-তিন ঘণ্টা ব্যাকআপ দেয়।
আধ ঘণ্টা রেলের টিকেট বিক্রয় বন্ধ ॥ বিদ্যুত না থাকায় ২৫ মিনিট টিকেট বিক্রয় বন্ধ ছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টারে। মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিদ্যুত না থাকায় কমলাপুর রেলস্টেশনে বিকল্পভাবে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বিকেল ৪টার দিকে হঠাৎ জেনারেটরের বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তেল না থাকার কারণে প্রায় আধঘণ্টা বিদ্যুতহীন ছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। এ সময় কাউন্টারে টিকেট বিক্রয় বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইনে টিকেট প্রত্যাশীরা ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে যাত্রীরা জানান।
জানা গেছে, জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দেয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা দুপুর থেকে বিদ্যুতহীন হয়ে পড়ে। বিদ্যুত না থাকায় রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনেও সেবা বিঘিœত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিদ্যুত না থাকায় কমলাপুর রেলস্টেশনে বিকল্পভাবে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। তাই বিদ্যুত যাওয়ার পর থেকে জেনারেটর চলছিল স্টেশনে। কিন্তু এর মধ্যেও বিকেল ৪টা থেকে ৪টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত কাউন্টারে বিদ্যুত সরবরাহ ছিল না। ফলে এই ২৫ মিনিটে কোন টিকেট বিক্রয় সম্ভব হয়নি। এতে, কাউন্টারের সামনে থাকা টিকেট প্রত্যাশীরা অধৈর্য হয়ে পড়েন। পরে বিদ্যুত সরবরাহ ঠিক হলে সাড়ে ৪টার দিকে টিকেট বিক্রয় শুরু হয় বলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তারা জানান।
তেল কিনতে পাম্পে ভিড়; জাতীয় গ্রিডে ভয়াবহ বিদ্যুত বিপর্যয়ে জরুরী কাজ চালিয়ে নিতে জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে মানুষ। এ কারণে ঢাকাসহ সারাদেশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে ভিড় বেড়ে যায়। তেল কিনতে কনটেনার হাতে ডিজেল কিনতে পাম্পে লাইনে দাঁড়ায় মানুষ।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নীলক্ষেত মোড় এলাকায় পথের বন্ধু ফিলিং স্টেশন, মালিবাগ অটো সার্ভিস, নীলক্ষেত এলাকায় কাজী গোলাম সামদানী পাম্প, উত্তর বাড্ডা এলাকায় আল-মক্কা পাম্পে গ্যালন হাতে তেল নিতে মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
নীলক্ষেতের পথের বন্ধু ফিলিং স্টেশনে দেখা গেছে, তেল নিতে আসা গ্রাহকদের দীর্ঘ সারি। অনেকেই এসেছেন ৫ লিটার থেকে ২০ লিটারের ধারণক্ষমতার কন্টেনার নিয়ে। আবার কেউ কেউ এসেছেন মাঝারি ধরনের ব্যারেল নিয়েও। তারা বলেন, বিদ্যুত নেই। এখন জেনারেটরই ভরসা। বিদ্যুত গেলে কী হবে, অফিস বা বাসার  জেনারেটর তো চালাতে হবে। এজন্য তেল কিনতে এসেছি।
বারবার কেন সমস্যা ॥ ২০১৪ সালের পর এটাই হতে যাচ্ছে বিদ্যুত সরবরাহের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এ সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধানে ৯ ঘণ্টার মতো সময় লাগতে পারে। এক মাস আগেই জাতীয় গ্রিডের আরেকটি সঞ্চালন লাইনের বিভ্রাটে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুতহীন থাকে।
এবারও জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বড় এলাকা বিদ্যুতহীন হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিদ্যুতের সরবরাহ লাইনে বিপর্যয় ঘটেছে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। আমাদের টিম অলরেডি কাজ শুরু করেছে।
তিনি জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের বড় এলাকা এই বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে, পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের আরও কিছু এলাকায় আংশিক বিদ্যুত চলে গেছে। তিনি বলেন, ‘এক এলাকায় সমস্যা হলে সেটা অন্য এলাকাকেও আক্রান্ত করে। তবে কোন অঞ্চল থেকে সমস্যার সূত্রপাত, সেটা টেকনিক্যাল কারণে আমরা এখনই বলছি না।’
এক মাস আগেই জাতীয় গ্রিডের আরেকটি সঞ্চালন লাইনের বিভ্রাটে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুতহীন থাকে। বারবার কেন সমস্যা হচ্ছে- এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণেই এমনটি হয়েছে বলে আমরা মনে করি। ওভারলোডের কারণে সমস্যা হয়নি। তবে আরও কোন কারণ আছে কিনা তা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় প্রয়োজন।’
প্রসঙ্গত, গত মাসেও জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনের বিভ্রাটে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুতহীন হয়ে পড়েছিল। তখন প্রায় ৫ বছর পর আবারও বিদ্যুতের ব্ল্যাক আউটের কবলে পড়ে দেশ। ঈশ্বরদী ২৩০/১৩২ উপকেন্দ্রে ত্রুটির কারণে ৬ সেপ্টেম্বর সকালে হঠাৎ করেই বিদ্যুতহীন হয়ে পড়ে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বেশ কিছু এলাকা।

এর মধ্যে খুলনা ও বরিশালের অঞ্চলগুলো প্রায় ৩ ঘণ্টা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন ছিল। তাৎক্ষণিক তৎপরতায় রাজশাহী অঞ্চলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তীব্র গরমে দুর্ভোগ পোহাতে হয় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষজনকে। শুধু তাই নয় এসব এলাকার শিল্পকারখানাগুলোতে ব্যাহত হয় উৎপাদন কার্যক্রম। আকস্মিক এ ঘটনার তদন্ত একটি কমিটি গঠন করা হলেও প্রায় এক মাস পরও তাদের প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
এরও আগে ২০১৭ সালের ৩ মে আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমের জনপদের ৩২ জেলা মঙ্গলবার কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়। ওইসময় দিনের শেষভাগে এসে বিদ্যুতের সরবরাহ পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে। গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে এই এলাকার ২৭ বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি করা ৫০০ মেগাওয়াট কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ ছিল। ২০১৪ সালের ১ নবেম্বর বাংলাদেশ-ভারত সঞ্চালন লাইনের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারাতে এ ধরনের বিপর্যয়ের কারণে সারাদেশ বিদ্যুতহীন হয়।

×