ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

স্টুডিও ব্যবসার একাল (১)

প্রতি তিন মাসে বন্ধ হচ্ছে ১০ স্টুডিও

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

প্রতি তিন মাসে বন্ধ হচ্ছে ১০ স্টুডিও

ব্যবসা আগরে মতো না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে অধকিাংশই। শুধু দুটি স্টুডওি ও কালার ল্যাব টকিে আছে

 ডিজিটাল জামানায় পকেটে পকেটে ঘুরছে ক্যামেরা। চাইলেই যে কোন স্থানে ফ্রেমবন্দী করা যায় নিজেকে। বাড়ির আঙিনা থেকে হাটে-মাঠে-ঘাটে কিংবা বাজারের কোলাহলময় স্থানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা যায়। রেস্তরাঁ, বিনোদন কেন্দ্রে বসেও তোলা যাচ্ছে ছবি। নিসর্গের হাতছানিময় পাহাড়, বন থেকে সমুদ্রভ্রমণের ছবিটিও ধারণ করা যায় সহজে। এমনকি ছোটখাটো পারিবারিক অনুষ্ঠানের ছবির কাজও চলে যায় মুঠোফোনের ক্যামেরায়। আর কারও কাছে ডিএসএলআর ক্যামেরা থাকলে তো কথাই নেই। সব ধরনের ছবিই ধারণ করা যায়। এমন বাস্তবতায় গ্রাহকের অভাবে ধুঁকছে রাজধানীর ফটো স্টুডিওসমূহ। দিনকে দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে স্টুডিও ব্যবসা।
জানা গেছে, প্রতি তিন মাসে বন্ধ হচ্ছে দশটি করে স্টুডিও। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের অভিঘাতে একসময়ের রমরমা ব্যবসাটি বর্র্তমানে পরিণত হয়েছে রুগ্ন শিল্পে।

বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকার অসংখ্য স্টুডিও। গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও রাজধানীতে আড়াই হাজারের বেশি ফটো স্টুডিও থাকলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচশতে। উল্টোদিকে বৈধ স্টুডিওর সংখ্যা কমে বেড়েছে লাইসেন্সহীন অবৈধ স্টুডিও। স্টুডিও ব্যবসা সঙ্কুচিত হওয়ার নেপথ্যে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্রেড লাইসেন্সহীন অবৈধ স্টুডিও।
মূলত ২০০৩ সালের পর থেকে ডিজিটাল বাস্তবতায় নতুন সময়ের মুখোমুখি হতে হয় ঢাকাসহ সারাদেশের ফটো স্টুডিওসমূহকে। মোবাইলের বদৌলতে হাতে হাতে ক্যামেরা পৌঁছে যাওয়ায় প্রযুক্তির অভিঘাতটি ধীরে ধীরে নেমে আসে স্টুডিও ব্যবসায়। ফলে এক সময়কার অভিজাত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাটি হারিয়ে ফেলে স্রোতস্বিনী গতিপথ। ভোক্তাশূন্যতায় সঙ্কুুচিত হতে থাকে ব্যবসার পরিধি। ক্রেতার অভাবে একে একে বন্ধ হতে থাকে স্টুডিওর দরজা। সাধারণত এখন আর কেউ পাসপোর্ট বা ভিসাসংক্রান্ত ছবির প্রয়োজন ছাড়া স্টুডিওমুখী হয় না। স্টুডিওর দেয়ালে লেপটে থাকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে ফ্রেমবন্দী করার বিষয়টি এখন মরচে পড়া সোনালী অতীত। শেষ হয়েছে উৎসব-পার্বণে বা পরিবারের সকলে মিলে শখের ছবি তোলার জন্য স্টুডিওতে যাওয়ার দিন। এমন বাস্তবতায় গ্রাহকের অভাবে সহজাতভাবেই থমকে গেছে অজস্র স্টুডিওর পথচলা। অনেক স্টুডিও কর্মচারী কমিয়ে ন্যূনতম মুনাফা করে টিকে আছে।

এর মধ্যে স্বনামধন্য কিছু স্টুডিও টিকে আছে কোনমতে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্টুডিও বাঁচিয়ে রাখতে ছবির পাশাপাশি প্লেট, মগ বা টি- শার্টে ছবি ছাপিয়ে চলছে অনেকের ব্যবসা। স্টুডিওতে ছবি তোলার বাইরে ব্যাংক-বীমাসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্ভর হয়ে পড়েছে কারও ব্যবসা। তবে এই সংখ্যা হাতে গোনা সামান্যসংখ্যক স্টুডিওর। স্টুডিও ব্যবসাকে ছাপিয়ে এখন জমজমাট আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলানো বিভিন্ন এজেন্সি নির্ভর ফ্যাশন বা মডেল ফটোগ্রাফি, বিয়ের অনুষ্ঠান বা ওয়েডিং ফটোগ্রাফির ব্যবসা। সড়কের পাশের স্টুডিওর বদলে গুলশান, নিকুঞ্জ, উত্তরাসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটে গড়ে উঠেছে এজেন্সি বা ব্যক্তিনির্ভর এসব প্রতিষ্ঠান।
এক সময় এই শহরের এক জায়গায় সবচেয়ে বেশি স্টুডিওকে ধারণ করেছিল পুরান ঢাকার হাটখোলা রোড। সেই সুবাদে স্টুডিওপাড়া হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল এলাকাটি। সড়কের ধারে একের পর এক গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল বীথি, মারলিন, মেক্সিকোসহ বাহারি নামের প্রায় ৪০টি স্টুডিও। নিম্নমুখী ব্যবসার গতিধারায় কমতে কমতে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র চারটিতে। এই চারটির মধ্যে বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করে স্টুডিও ২৭। ৩৭ বছর আগে স্টুডিওটি প্রতিষ্ঠা করেন শেখ হামিদুল হক কচি। চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টুডিওটি এখনও টিকে আছে। আলাপচারিতায় প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান স্বত্বাধিকারী শেখ তাহমিদুল হক নাহিন জনকণ্ঠকে বলেন, শুধুমাত্র পূর্ব সুনামের কারণে ব্যবসাটা কোনমতে বেঁচে আছে। হাতের নাগালে থাকা মুঠোফোনের ক্যামেরা ও ডিএসএলআর ক্যামেরার সহজলভ্যতায় সহজে কেউ স্টুডিওতে আসে না। এখন আর মানুষ উৎসব-পার্বণে ছবি তুলতে আসে না। বন্ধ হয়ে গেছে ঈদ, পূজাসহ বিশেষ দিবস বা উৎসব নির্ভর ছবি তোলার প্রথা। স্টুডিওতে এসে পরিবার কিংবা দলবেঁধে ছবি তোলারও প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে মূলত পাসপোর্ট বা ভিসাসংক্রান্ত ছবি তোলায় সীমাবদ্ধ আমাদের ভোক্তা। তাই স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কুচিত হয়েছে স্টুডিও ব্যবসা। কমেছে লাভের পরিমাণ। মুনাফার চেয়ে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই বড় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অথচ এক সময় ছবি তোলা মানেই ছিল স্টুডিওতে যাওয়া।

এমনকি বর্তমানের ফ্যাশন বা ওয়েডিং ফটোগ্রাফিও ছিল স্টুডিও নির্ভর। এর বাইরে ফিল্ম বিক্রি বা নেগেটিভ থেকে ছবি ওয়াশের মাধ্যমেও মুনাফা যুক্ত হতো। এখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ডিজিটাল ইমেজের কারণে হারিয়ে গেছে ডার্করুমে কেমিক্যালের মিশ্রণে নেগেটিভ থেকে ছবি তৈরির কৌশলী কাজটি।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা নিউ ইস্কাটনে এক সময় চারটি স্টুডিও ছিল। এর মধ্যে গত শতকের ষাটের দশকে গড়ে ওঠা শাপলাসহ তিনটি স্টুডিও ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে কেবল ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত পদ্মা স্টুডিও। একসময়ের জমজমাট স্টুডিওটি এখন কোনমতে দিন পার করছে।
এ প্রসঙ্গে স্টুডিওটির মালিক আক্কাস মাহমুদ বলেন, এক সময় নিত্যদিনের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিল স্টুডিও। ছবি তুলতে হলে স্টুডিওর কোন বিকল্প ছিল না। ঈদের দিন মানুষ নতুন পোশাক গায়ে চাপিয়ে চলে আসত স্টুডিওতে। ব্যাকড্রপে থাকা নদী-পাহাড়সহ প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে ছবি তুলে আনন্দময় মুহূর্তকে আরও বেশি রঙিন করে তুলত। নিসর্গকে সঙ্গী করে ফ্রেমবন্দী হওয়া ছিল কাস্টমারের বিশেষ চাহিদা। সেই কাজটি এখন ফটোশপেই করা যায়। ছবির সঙ্গে যে কোন দৃশ্য জুড়ে দেয়া যায়। সব মিলিয়ে তখন আপামর মানুষের বিনোদনের অংশ ছিল স্টুডিও। এমনকি বাবা-মা বা দাদা-দাদিসহ পরিবারের কেউ বয়োবৃদ্ধ হলে স্মৃতি ধরে রাখতে তাকে স্টুডিওতে নিয়ে এসে ছবি তোলা হতো। ছবিটি বাঁধাই করা হতো। ফলে ফ্রেমসহ লেমিনেটিং ও এ্যালবামের আলাদা ব্যবসা হতো। সে কারণে ডিজিটাল যুগের আগে ফিল্মের আমল পর্যন্ত সরগরম ছিল স্টুডিও ব্যবসা। তখন ফটোগ্রাফি জানা অভিজাত লোকজন এই ব্যবসা করত। এমনকি এই ব্যবসা করে গাড়ি-বাড়িরও মালিক হয়েছেন অনেকে। কিন্তু অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে সেই সুদিন। হাতের মুঠোয় ক্যামেরা থাকায় অতিপ্রয়োজন ছাড়া স্টুডিওতে পা ফেলে না মানুষ। বর্তমানে কেবলমাত্র শিক্ষিত ও সচেতন লোকজন পাসপোর্ট সাইজের ছবি জন্য স্টুডিওতে আসে। বিদেশগামীদের অনেকেই মানসম্পন্ন ছবির জন্য বাধ্য হয়ে আসেন। প্রয়োজনের তাগিদে কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষার্থী অভিভাবকের সঙ্গে বাৎসরিকভাবে একবার ছবি তোলার জন্য আসে। তারাও আবার নামী স্টুডিও ছাড়া অন্য কোথাও যায় না। এগুলোর ওপরই টিকে আছে স্টুডিও ব্যবসা। এছাড়া ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে কম টাকায় ছবি তোলার সুবিধা পেয়ে আমজনতা সাধারণত স্টুডিওমুখী হয় না। সব মিলিয়ে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে স্টুডিও ব্যবসা পরিণত হয়েছে রুগ্ন শিল্পে। প্রতি তিন মাসে বন্ধ হচ্ছে দশটি করে স্টুডিও। নব্বইয়ের দশকে রাজধানীতে লাইসেন্সধারী আড়াই হাজারের বেশি স্টুডিও থাকলেও এখন সেই সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচশতে ঠেকেছে। আগে দিনে ১৫ হাজার টাকার ব্যবসা হলে বর্তমানে ৪ হাজার টাকার ব্যবসা হয়। মূলত ২০০৩-২০০৪ সাল থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে স্টুডিওর চাহিদা। হাতে হাতে ঘুরতে থাকা মুঠোফোনের ক্যামেরা দিয়েই কাজ চলে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে টি-শার্ট, প্লেটে বা মগে ছবি ছাপানোর কাজ করতে হচ্ছে।
স্টুডিও ব্যবসার বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোক্তার পরিবর্তে কর্পোরেট ক্লায়েন্টের মাধ্যমে টিকে আছে নয়া পল্টনের ফটো ম্যাজিক স্টুডিও। এ প্রসঙ্গে স্টুডিওটির স্বত্বাধিকারী আলী মুর্তজা বলেন, ডিজিটাল যুগে ক্রমশ কাস্টমার কমছে। এমন প্রেক্ষাপটে স্টুডিওতে ছবি তুলতে আসা ভোক্তার বদলে নির্ভর করতে হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। সেই সুবাদে ব্যাংক-বীমা, শিল্প-প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারী-বেসরকারী অফিসের কাজ দিয়ে মূলত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। এই কর্পোরেট ক্লায়েন্ট না থাকলে আমাকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হতো।
ছয় দশক পেরিয়ে ১৯৬২ সালে বেইলি রোডে প্রতিষ্ঠিত ফটোম্যাটিক নামের স্টুডিওটি এখনও টিকে আছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক সোহেল রানা বলেন, এক সময় ব্যাপক খ্যাতি অর্জনের কারণে আমরা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ধাক্কা সামলে নিতে পেরেছি। মানসম্মত ছবির মাধ্যমে গ্রাহক ধরে রেখেছি। এক্ষেত্রে একজন কাস্টমার আরেকজনকে প্রভাবিত করেছে। সে কারণে একই পরিবারের কয়েক প্রজন্মের সদস্য এসেছে এই স্টুডিওতে। তা না হলে এতদিন টিকে থাকতে পারতাম না।
রাজধানীতে গড়ে ওঠা পাঁচ ভাগের একভাগ স্টুডিও টিকে থাকলেও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে নানা সমস্যার বেড়াজালে বন্ধ হয়ে গেছে বহু পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত স্টুডিও। স্বাধীনতা পূর্ব ষাটের দশক থেকে সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠিত এসব স্টুডিও ভোক্তার পদভারে দারুণ সরব থাকত। থেমে গেছে তাদের পথচলা। তেমনই এক জনপ্রিয় স্টুডিও ছিল ষাটের দশকে ইস্কাটনে প্রতিষ্ঠিত শাপলা স্টুডিও। বন্ধ হয়ে গেছে স্টুডিওটি। হারিয়ে গেছে ষাটের দশকে নবাবপুর রোডে গড়ে ওঠা জনপ্রিয় স্টুডিও এইচ। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে স্টেডিয়াম এলাকার ফটোগ্রাফো। থেমে গেছে তোপখানা রোডের কামড় নামের স্টুডিওর পথচলা। দেশভাগের আগে নবাবপুর রোডে গড়ে উঠেছিল স্টুডিও ডজ এ্যান্ড কোং। সেটিও এখন আর নেই। বন্ধ হয়ে গেছে নিউমার্কেটের বলাকা ভবনের স্টুডিও সিকো। নিখোঁজ হয়েছে পল্টন মোড়ে প্রতিষ্ঠিত স্টুডিও জাইদিস।

 

×