তিস্তা সঙ্কট কেটে যাবে
আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগেই নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সুখবর পাচ্ছে বাংলাদেশ। আগস্টের শেষ সপ্তাহে দুই দেশের পানিসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রীদের বৈঠকে এই বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ছাড়া তিস্তা নিয়েও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে দিল্লী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপ্যাধায়ের কিছুটা নমনীয়তায় তিস্তা নিয়ে চূড়ান্ত চুক্তি না হলেও সেক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে।
যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকের বিষয়ে উভয় দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোন মন্তব্য না করলেও ভারতের গণমাধ্যমে দ্য হিন্দু পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তির সম্ভাবনার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। এছাড়া সম্প্রতি ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক অটুট রাখার লক্ষ্যে-সেন্টার ফর বাংলাদেশ ইন্ডিয়া রিলেশন্সের (সিবিআইআর) উদ্যোগে আয়োজিত সভায় বিজেপির সাবেক যুব সংগঠন সম্পাদক ও বর্তমানে মুখপাত্র সৌরভ শিকদার বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে অনেক অমীমাংসিত বিষয়ে সুরাহা হবে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি। নদীর পানি বণ্টনসহ বিদ্যমান অন্যান্য সমস্যা কাটিয়ে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
ভারতের গণমাধ্যম দ্য হিন্দু নির্ভরশীল সূত্রের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর পানির সুষম বণ্টন নিশ্চিতে গঠিত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ক চুক্তি প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছেন। শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগেই চুক্তিটি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কমিশনের দুই দেশের সরকারী প্রতিনিধিরা।
সাম্প্রতিক বর্ষায় দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর পানি বেড়ে তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যার ব্যাপারটিও গুরুত্ব পাচ্ছে জেআরসির ভারত ও বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের আলোচনায়। গত জুন-জুলাই মাসে অতি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে নদীর পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসম ও তার সীমান্তঘেঁষা বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে ব্যাপক বন্যার ঘটনা আমলে নিয়ে এ ধরনের দুর্যোগ প্রতিরোধে যৌথভাবে কাজ করতে চায় কমিশন।
জুন মাসে দুই দেশের যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) নদীর পানির নায্য হিস্যা এবং পাহাড়ী ঢলে বাংলাদেশে সিলেট সুনামগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ফোরাম জেসিসির সপ্তম বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। আর ভারতের নেতৃত্ব দেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
দুই দেশের যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে দুই প্রতিবেশীর বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক স্বার্থে বিভিন্ন বিষয়ের সুরাহা এবং টেকসই সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনে সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে জয়শঙ্কর বলেন, দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বহু দিন ধরে। তিস্তা নিয়ে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা বিষয়ে মীমাংসার জন্য গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রথম দিল্লী সফরে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের সময় বিষয়টি উত্থাপন করেন তিনি। তবে বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক ফল আসেনি। এরপরেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দাবি জানানো হয়।
গত ২০২১ সালের মার্চে নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরের সময়ও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল তিস্তা। কিন্তু সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তিস্তার অচলাবস্থা কাটছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতেই ঝুলে যায় চুক্তিটি।
গত সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করতে দিল্লী যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ইস্যুর পাশাপাশি তিস্তা নিয়ে বৈঠক হয়েছে উভয়ের মধ্যে। ওই বৈঠকে তিস্তার বিষয়েও একটি সুরাহায় পৌঁছেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তবে এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তারা, তা স্পষ্ট জানা যায়নি। সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য হিন্দু এসব তথ্য জানিয়েছে।
উভয় দেশের মধ্যে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর জলসম্পদ বণ্টন, সেচ এবং বন্যা ও এই জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যৌথভাবে মোকাবেলা করতে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসি।
কিন্তু এই কমিশনের ধারাবাহিকতায় বার বার ছেদ পড়েছে। জেআরসির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল ২০১০ সালে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরকে গুরুত্ব দিয়েই ফের তৎপর হয়ে উঠেছে জেআরসি। নরেন্দ্র মোদির ২০২১ সালের বাংলাদেশ সফরের পর শেখ হাসিনার ভারত সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আগামী বছর শেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে ভারতে তার শেষ সফর হতে পারে এটি। তার সফরের ফল আগামী এক বছরে বাংলাদেশবাসীর কাছে নতুন বার্তা দেবে।
করোনা পরবর্তী এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জ্বালানি সঙ্কট, খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বই এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার প্রধানের ভারত সফরে দুই দেশ জ্বালানি, খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলাসহ অন্যান্য সমসাময়িক ইস্যুতে মতৈক্য আসতে পারে।