ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার জন্মবার্ষিকী

তিনি কাজ করে গেছেন নীরবে নিভৃতে

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ৭ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ২৩:৩৫, ৭ আগস্ট ২০২২

তিনি কাজ করে গেছেন নীরবে নিভৃতে

.

মনটি ছিল সাধারণ বাঙালী মায়ের চেয়েও কোমল। কিন্তু অন্যায়ের বিপক্ষে অনেকক্ষেত্রে ছিলেন স্বামীর চেয়েও কঠিন। দুঃখ-ক্লেশ সহ্যের পরিমাণ ছিল ধারণাতীত। কখনও বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতার স্ত্রী, কখনও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, কখনও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী; জীবনের সকল পর্যায়েই তিনি নিঃস্বার্থভাবে জীবন ও যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্কটের সঙ্গী হয়ে, জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে। আত্মকেন্দ্রিকতা বা আত্মসর্বস্বতা কখনও স্পর্শ করতে পারেনি এই নির্লোভ মহীয়সীকে। প্রচারবিমুখ এই মহীয়সী কাজ করে গেছেন নীরবে-নিভৃতে। হাসিমুখে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করে অভূতপূর্ব ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এই মহীয়সী।
তিনি আর কেউ নন। তিনি হচ্ছেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গমাতার ডাকনাম ছিল রেণু। স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, মহীয়সী এই বঙ্গমাতার আজ ৯২তম জন্মবার্ষিকী। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব একে অপরের সম্পূরক। বাংলার ইতিহাসে জাতির সংগ্রামী নেতৃত্ব সৃষ্টিতে নীরবে নেপথ্যে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন বঙ্গমাতা। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন।
একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর সংসারে হাল ধরেছেন। অন্যদিকে সেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছিলেন নেপথ্যের মহীরুহ। বঙ্গমাতা কেবল প্রেমময়ী স্ত্রী, স্বার্থ বিসর্জনকারী ত্যাগী নারীই ছিলেন না; ছিলেন একজন আদর্শ মা। সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধু, ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং সাহসী যোদ্ধা এক বিচক্ষণ নারী। যে কারণে তাঁর সাহচর্যে, অসীম ত্যাগ ও প্রেরণায় শেখ মুজিবুর রহমান হতে পেরেছেন ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা’।
১৯৩০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতা হত্যাকারীদের নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে স্বামী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনিও শাহাদত বরণ করেন। মরণেও সঙ্গী হয়েছিলেন বাংলার বাস্তব স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, নজিরবিহীন ত্যাগী এই অসাধারণ মহীয়সী নারী।
শহীদ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা জহুরুল হক ও পাঁচ বছর বয়সে মাতা হোসনে আরা বেগমকে হারান। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘রেণু’। তখন তাঁর দাদা শেখ আবুল কাশেম চাচাত ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন নেছার বিবাহ দেন। তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুনের মাতৃ¯েœহ, মায়া-মমতায় বেগম ফজিলাতুন নেছাকে লালন-পালন করেন।
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে বঙ্গমাতা প্রাথমিক লেখাপড়া করেন। তখনকার দিনে সামাজিক অবরোধ প্রথার কারণে দশ বছরের মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারত না। সামাজিক রীতি-নীতির কারণে গ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল বঙ্গমাতার অদম্য আগ্রহ। তিনি এ সময় থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্রের বই আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন।

প্রবল স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। যে কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁকে সারা জীবনের জীবন্ত ডায়েরির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালী নারী ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, অসীম  ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যে কোন পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতেন। তাঁর কোন বৈষয়িক চাহিদা ও মোহ ছিল না। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মানুষকে মুক্তহস্তে দান করতেন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর নেয়া ও পরিবার-পরিজনের যে কোন সঙ্কটে পাশে দাঁড়াতেন।
অসাধারণ বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেণু। সে কারণে দেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি স্বামীকে, জনগণকে দৃঢ়চিত্তে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে প্রেরণা দিয়েছেন, উদ্দীপিত করেছেন নিজ মেধা ও মননে। একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থেকে স্বামী বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কর্মকা- ও চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। প্রচারবিমুখ এই মহীয়সী কাজ করে গেছেন নীরবে-নিভৃতে। বাঙালীর স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রামে তাঁকে অনেক কষ্ট, দুর্ভোগ ও ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে, কিন্তু কখনও মনোবল বা সাহস হারাননি। বঙ্গবন্ধুর জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম মুজিব।
দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধু জীবনের অধিকাংশ সময়ে কারাবাস ও রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বঙ্গমাতা নিজেই ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, পরিবার-পরিজনদের খোঁজখবর নেয়াসহ পুরো দায়ভার বহন করতেন। দলীয় কর্মীসহ আত্মীয়স্বজনের সব সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলেন বঙ্গমাতা। ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন স্বামীর আদর্শ। রাজনৈতিক জীবনসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি স্বামীর পাশে থাকতেন। নিজ বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক জটিল পরিস্থিতিতে সঠিক পরামর্শ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন।
স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গমাতা সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন। জীবনে কোন চাহিদা বা মোহ ছিল না তাঁর।

চরম দুঃসময়ে নিজের গায়ের গহনা পর্যন্ত বিক্রি করে সংসার ও দলকে পরিচালনা করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। হাসিমুখে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করে অভূতপূর্ব ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এই মহীয়সী নারী। প্রতিটি সঙ্কটকালে বঙ্গবন্ধুকে সঠিক পথ দেখাতেন বঙ্গমাতা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে থাকার সময় মুচলেকা দিয়ে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেয়ার ব্যাপারে দলের কতিপয় নেতার নেয়া সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। এমনকি একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগেও বঙ্গবন্ধুকে অনেক অনেক রকম পরামর্শ দিলেও সঠিক পরামর্শটি দিয়েছিলেন তাঁর সহধর্মিণীই। তিনি বঙ্গবন্ধুকে একটি কথাই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু যেন তাঁর নিজের মনে যা আছে তা-ই ওই ভাষণে বলেন।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি কখনও লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ ও বিলাসিতার কথা চিন্তা করেননি। এমনকি তিনি আত্মীয়স্বজন ও সাধারণ মানুষের সংযোগ ছেড়ে গণভবনে যাননি। ৩২ নম্বর রোডের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুর জন্য খাবার পাঠাতেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই মহীয়সী নারী সর্বদা স্বামীর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে মানবকল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। ইতিহাসের এক নিষ্ঠুরতম ঘটনার শিকার হয়ে ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে স্বামীর সঙ্গে তাঁকেও জীবন দিতে হয়েছিল। মরণেরও সাথী হয়ে থাকলেন বাংলার বাস্তব স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, নজিরবিহীন ত্যাগী এই অসাধারণ  নারী।
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে সরকারী ও বেসরকারীভাবে গ্রহণ করা হয়েছে নানা কর্মসূচী। দিনটি জাতীয়ভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে বিস্তারিত কর্মসূচী। দ্বিতীয় বছরের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাঁচ বিশিষ্ট নারীকে ‘বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক’ প্রদান করা হবে। আজ সোমবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আজ বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, শ্রদ্ধা নিবেদনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- আজ সকাল ৮টায় বনানী কবরস্থানে বঙ্গমাতা শহীদ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের কবরে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, কোরান খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।

 

×