আহিনা খাতুন
লিভ টুগেদার করার পর আরেক মেয়েকে বিয়ে করায় করুণ পরিণতি ঘটে আলী নূরের। এতে তাকে জীবন দিতে হয়েছে প্রেমিকা আহিনার নৃশংস হামলায়। এমনই এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে র্যাব-৪। ঘাতক আহিনাকে গ্রেফতারের পর প্রকাশ করেন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
র্যাব জানিয়েছে, বছর তিনেক আগে আলী নূরের সঙ্গে পরিচয় হয় আহিনা খাতুনের। এরপর তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর সম্পর্ক। একপর্যায়ে তারা একটি বাসা ভাড়া নিয়ে লিভ টুগেদার শুরু করেন। বিয়ে না করেই স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকতেন তারা। এভাবেই কাটতে থাকে তাদের দিন। কিন্তু ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে ৩০ জুলাই। এদিন আলী নূরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যায় আহিনা খাতুন জড়িত।
জিজ্ঞাসাবাদে আহিনা খাতুন জানান, গত ১৪ জুলাই আলী নূর তার গ্রামের বাড়িতে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। এ কথা শুনে আলী নূরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাতে ঘুমন্ত আলী নূরকে বঁটি দিয়ে মাথা, গলা এবং বুকে কুপিয়ে হত্যা করেন আহিনা খাতুন। এরপর রক্তাক্ত লাশ দেখে ভয় পেয়ে যান তিনি। এ সময় লাশটি কাঁথা চাপা দিয়ে পালিয়ে যান আহিনা খাতুন। সাভারের আশুলিয়ায় চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আহিনা খাতুনকে (২৯) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৪।
নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বুধবার কাওরান বাজারে সংবাদ সম্মেলনে লোমহর্ষক এ হত্যাকা-ের বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তিনি জানান, নিহত আলী নূর মাগুরার শ্রীপুরে থাকতেন। ২০১৪ সালে চাকরির সন্ধানে ঢাকা আসেন। ঢাকা এসে প্রথমে পোশাককর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন ধরে তিনি অটোরিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
আলী নূর ও আহিনা খাতুন পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে না করেই স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে আশুলিয়ায় বিভিন্ন বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতে থাকেন। গত তিন বছরে তারা পাঁচবার বাসা পরিবর্তন করেন। আলী নূর কিছুদিনের জন্য তার গ্রামের বাড়ি গেলে আহিনা খাতুন জানতে পারেন যে, ১৪ জুলাই আলী নূর তার গ্রামের বাড়িতে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেছেন।
এরপর আলী নূর ১৭ জুলাই ঢাকায় ফিরে আসেন। আলী নূরের বিয়ের কথা জানতে পেরে আহিনার মনে প্রচ- রাগ তৈরি হয়। এরপর আলী নূরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আহিনা। তাদের মধ্যকার মান-অভিমান চলতে থাকলেও ২৯ জুলাই আশুলিয়ার জিরাবোর নামাপাড়ায় একটি টিনশেড বাসায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস শুরু করেন।
র্যাব জানায়, এ বাসায় ঘটে হত্যাকা- ৩০ জুলাই রাতের খাবার শেষে ঘুমিয়ে পড়েন তারা। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী আহিনা খাতুন সেদিন ভোররাতে আলী নূরকে ঘুমন্ত অবস্থায় নৃশংসভাবে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। আসামির বক্তব্য অনুযায়ী রক্তাক্ত লাশ দেখে তিনি কিছুটা ভয় পেয়ে যান। ফলে লাশটি কাঁথা চাপা দিয়ে রাখেন।
হত্যার পর আহিনা তার থালা-বাসন ও কাপড় একটি বস্তায় ভরে ঘর বাইরে থেকে তালা দেন। এরপর সেই বস্তা নিয়ে হেঁটে প্রথমে জিরাবো বাসস্ট্যান্ড যান। সেখান থেকে বাসে আবদুল্লাহপুর। এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বাসে কুড়িল বিশ্বরোডে আসেন আহিনা। এরপর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বাসে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকায় যান। সেখানে আহিনা নিজেকে চাকরিপ্রত্যাশী পোশাককর্মী পরিচয় দিয়ে ২ হাজার ২০০ টাকা ভাড়ায় একটি টিনশেড বাসায় ওঠেন। পরে আহিনা বিবেকের তাড়নায় ৩১ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে নিহতের ভগ্নিপতিকে ফোন দেন। আলী নূর অসুস্থ অবস্থায় আছে।
তাকে বাঁচাতে তার পরিবার যেন দ্রুত আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় দেলোয়ার বেপারীর বাসায় যান। এরপর ১ আগস্ট দুপুরের দিকে ভিকটিমের পরিবারের লোকজন সেই বাসায় গিয়ে দেখতে পান ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। তারা বাসার মালিক ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় জানালা খুললে ভেতর থেকে তীব্র দুর্গন্ধ পান। জানালা দিয়ে দেখতে পান, মেঝেতে কাঁথা মোড়ানো অবস্থায় আলী নূরের মরদেহ পড়ে রয়েছে। পরে আশুলিয়া থানার পুলিশ এসে ঘরের তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে মরদেহটি উদ্ধার করে।
মোজাম্মেল বলেন, ঘটনাটি বিভিন্ন মিডিয়ায় এলে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে ২ আগস্ট নিহতের বড় ভাই বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-৪ আসামি গ্রেফতারে ছায়া তদন্ত শুরু করে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আহিনা খাতুনকে অভিযান চালিয়ে কাঁচপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার আহিনা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, নীলফামারীর একটি স্কুল থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তিনি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ।
২০১২ সালে মিজানুর রহমানের সঙ্গে তার প্রথম বিয়ে হলেও পারিবারিক কলহের জেরে দেড় বছর পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়। তার একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। পরে জীবিকার তাগিদে ছেলেকে বাবার বাড়ি রেখে ২০১৮ সালে ঢাকায় আসেন। এরপর আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। চাকরির সুবাদে আলী নূরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।