ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মাথা উঁচু করেই এগিয়ে চলেছে জনমানুষের কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মাথা উঁচু করেই এগিয়ে চলেছে জনমানুষের কণ্ঠস্বর

কাওসার রহমান ॥ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরন্তর বাহক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার সূতিকাগার দৈনিক জনকণ্ঠের ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ সোমবার। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’- এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। সেই থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে মাথা উঁচু করেই এগিয়ে চলেছে জনমানুষের এই কণ্ঠস্বর। দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরের অকুতোভয় এই গেরিলাযোদ্ধা মূলত তিনটি নীতির ভিত্তিতে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। একটি হচ্ছে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতির মহাকাব্য মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমুজ্জল রাখা এবং দ্বিতীয় হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং তৃতীয়টি হলো দেশের তৃণমূল মানুষের কাছে দিনের পত্রিকা দিনেই পৌঁছে দেয়া। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে নব্বইয়ের দশকেও দেশের তৃণমূল পর্যায়ে পত্রিকা পৌঁছাতে দুই থেকে তিনদিন লেগে যেত। তাই পত্রিকা প্রকাশের আগে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ চিন্তা করেন কীভাবে দিনের পত্রিকা পাঠকের হাতে দিনেই পৌঁছে দেয়া যায়। সেই নীতির আলোকেই মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে ১৯৯২ সালে শুরু হয় দেশের পাঁচ বিভাগীয় শহর থেকে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের উদ্যোগ। দেশ তখনও ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেনি, ছিল না কোন ইন্টারনেট ব্যবস্থা। এমনকি, কম্পিউটার ব্যবহারও ছিল সীমিত পর্যায়ে। ওই সময়ে দেশের পাঁচটি স্থান থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে নতুন একটি চাররঙা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ ছিল দুঃসাহসিক উদ্যোগ। আবার ঝুঁকিও ছিল অনেক। সাহসিকতার সঙ্গে সেই ঝুঁকি গ্রহণ করেছিলেন সংবাদপত্র প্রকাশের অগ্রসেনানী আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করে তিনি বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে পুরনো গতানুগতিক ধাঁচ উপড়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের পাঁচটি বৃহত্তর বিভাগীয় শহর থেকে একসঙ্গে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে দেশের সংবাদ মাধ্যমে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। রঙিন এই পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু হয়েছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া ও সিলেট থেকে। বগুড়া বিভাগীয় শহর না হলেও এটি হচ্ছে উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণেই রাজশাহীর পরিবর্তে বগুড়াকে বেছে নেয়া হয়েছিল উত্তরবঙ্গের বিভাগীয় শহর হিসেবে। সেই থেকে ভিন্ন এক বাস্তবতায় পথচলা শুরু করে দৈনিক জনকণ্ঠ, যখন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আজকের মতো অগ্রগতি ছিল না। কিন্তু পাঠককে প্রতিনিয়ত এগিয়ে রাখার সচেতন প্রয়াস ও দৃঢ় শপথেই বাজারে এলো এক নতুন দৈনিক পত্রিকা জনকণ্ঠ। আদর্শিক অবস্থান থেকেই পত্রিকা প্রকাশের জন্য ঐতিহাসিক এই দিনটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল। আজকের দিনে নতুন পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের আত্মপ্রকাশ নিত্য ঘটনা। নব্বই দশকের শুরুতে এ ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়ে পত্রিকাটি পাঠকের হাতে তুলে দেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। সংবাদপত্র শিল্পে ওই সময়ের বিনিয়োগ নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত করে। পথ দেখায় অন্যদের। শুরু থেকেই জনকণ্ঠ ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। ছিল বৈচিত্র্যে ঠাসা। তাই প্রথম প্রকাশের দিনেই মানুষের হাতে হাতে উঠে গিয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। ঢাকার একটি জাতীয় পত্রিকা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সকালেই পাঠকের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে পাঠক তা লুফে নেন। ফলে দ্রুতই দেশের একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয় দৈনিক জনকণ্ঠ। দ্রুত পাঠকপ্রিয়তার কারণে ১৯৯৪ সালেই দৈনিক জনকণ্ঠ প্রচার সংখ্যায় শীর্ষস্থানে উঠে আসে। এরপর থেকে বিগত ২৯ বছর ধরে কেবল নতুন করে দীপ্তি ছড়িয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠ। শুরুতে দৈনিক জনকণ্ঠের টিম সাজানো হয়েছিল তরুণ-প্রবীণের সংমিশ্রণে। এই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন দুই প্রথিতযশা সাংবাদিক-উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান এবং নির্বাহী সম্পাদক বোরহান আহমেদ। দুজনেরই ছিল পত্রিকা জগতে বিস্তর অভিজ্ঞতা। সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গে নিয়েছিলেন এক ঝাঁক মেধাবী সংবাদকর্মী ও কর্মচারী। বহুমাত্রিক প্রতিভা দিয়ে ঢেলে সাজানো হয়েছিল পত্রিকাটি। আতিকউল্লাহ খান মাসুদের চিন্তা ও চেতনাকে তারা বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে পত্রিকা প্রকাশের এক বছরের মধ্যেই দৈনিক জনকণ্ঠ দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় পরিণত হয়। প্রগতিশীল সম্পাদকীয় নীতিমালার মিশেলে সংবাদ পরিবেশনে দেশে এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করে দৈনিক জনকণ্ঠ। সৃষ্টি করে এক নবজাগরণ, যা সংবাদপত্র জগতে ইতিহাস হয়ে থাকবে। দৈনিক জনকণ্ঠের সাড়া জাগানো প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে ছিল সেই রাজাকার, সার সঙ্কট, আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা, দুর্নীতির রাহুগ্রাস, অপচিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে ধারাবাহিক ও বিশেষ প্রতিবেদন। দৈনিক জনকণ্ঠে তারই সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রকাশ করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘সেই রাজাকার’, যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জনমত সৃষ্টি করতে বিরাট ভূমিকা রাখছে। কলামগুলোর মধ্যে আবেদ খানের কলাম রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগে পাঠকের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য ‘শিক্ষা সাগর’ নামে নিয়মিত একটি পাতা এবং বিভিন্ন আকর্ষণের বিভাগ নিয়ে বর্ধিত কলেবরের কারণে দেশের প্রধান পত্রিকায় পরিণত হয় দৈনিক জনকণ্ঠ। দৈনিক শিক্ষা পাতা প্রচলনে জনকণ্ঠই দেশে পথিকৃৎ, এখন যা প্রায় সব দৈনিক অনুসরণ করছে। একইভাবে পূর্ণপাতা ‘ফ্যাশন’-এর প্রচলনও জনকণ্ঠই প্রথম করেছে। এ ছাড়াও পাঠকপ্রিয় হরেক রকম কলাম, ফিচার, সপ্তাহজুড়ে বিশেষ বিশেষ পাতা চালু, ঘটনার নেপথ্যের কাহিনীর বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে জনকণ্ঠ। প্রথমবারের মতো চালু করেছে আকর্ষণীয় আরও অনেক ফিচার, যেগুলো কেবল দৈনিক জনকণ্ঠকেই সমৃদ্ধ করেছে। পাঠকও সমৃদ্ধ হয়েছেন সেগুলো পাঠ করে। দৈনিক জনকণ্ঠ সমাজের প্রতি তার সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির বিষয়টি ভুলে যায়নি কখনও। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা দেশবরেণ্য বহু গুণীজনের জন্য মাসে মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক সম্মাননা চালু করে জনকণ্ঠ। বাংলাদেশে বেসরকারীভাবে এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। আবার গরিব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়মিত আর্থিক সহায়তাও দিয়ে গেছে নীরবে। দেশের ক্রীড়া জগতকে উন্নত করতে জনকণ্ঠের পৃষ্ঠপোষকতাও খুব প্রশংসিত হয়েছে। দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছে দৈনিক জনকণ্ঠ। বিশেষ করে, অভিন্ন চেতনার জায়গা থেকে বাঙালীর শিল্প-সংস্কৃতির নিজস্ব ধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে জন্মলগ্ন থেকেই। জাতীয় বসন্ত উৎসবসহ এ জাতীয় শিকড়সন্ধানী উৎসব অনুষ্ঠানে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দান করে। ছায়ানট বা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তহবিল গঠনে জনগণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। মানবিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে চালু করে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ বিভাগ। দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের পর প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টরা যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। তাদের লেখা প্রকাশের একটি সুযোগ তৈরি হয়। আর জনকণ্ঠের মাধ্যমে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা সমাজের অন্যায়-অবিচারগুলো তুলে ধরেছেন তাদের লেখনীর মাধ্যমে। দেশের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কলাম লিখে পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেন। বরেণ্য শিল্পী রণবী সমাজের অসঙ্গতিগুলো ধরিয়ে দিতে থাকেন তার বিখ্যাত কার্টুন সিরিজ দিয়ে। আবার জনকণ্ঠ নিজেও ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার হারিয়ে যাওয়া অনেক ইতিহাস, ঘটনা তুলে এনেছে তার পাতায়। পাঠকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছে অবলীলায়। ফলশ্রুতিতে জনকণ্ঠ হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির একটি প্রধান মুখপত্র। শুরু থেকেই দৈনিক জনকণ্ঠ দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায়, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। পত্রিকাটির ক্ষুরধার রিপোর্টিংয়ের কারণে তৎকালীন বিএনপি সরকারের জনমন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। একজন ছিলেন তৎকালীন সংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী আমিনুল ইসলাম এবং অন্যজন ছিলেন শিল্পমন্ত্রী জহিরউদ্দীন খান। প্রতিকূল পরিবেশে অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠের ওপর বারবার আঘাত এসেছে। কারণ, ধর্মান্ধ, ফতোয়াবাজ, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ছিল তৎপর। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের প্রতি ছিল রাষ্ট্রীয় মদদও। পত্রিকা প্রকাশের দ্বিতীয় বর্ষেই একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশের পর দৈনিক জনকণ্ঠের ওপর নেমে এসেছিল একটি বড় আঘাত। ১৯৯৪ সালের ১২ মে প্রকাশিত ওই উপ-সম্পাদকীয়র মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করায় চিহ্নিত মৌলবাদী গোষ্ঠী। জনকণ্ঠের সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান এবং নির্বাহী সম্পাদক বোরহান আহমেদ মামলার শিকার হন। সেই মামলায় তোয়াব খান ও বোরহান আহমেদকে জেলে যেতে হয়েছিল, আর সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে জেল এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। দৈনিক জনকণ্ঠ সব সময়ই ছিল মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদী অপশক্তির আতঙ্ক। তাই তো ধর্মীয় উগ্রবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ক্রমাগত কঠোর অবস্থানের কারণে ১৯৯৯ সালের ৮ আগস্ট এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হয় জনকণ্ঠকে। এদিন নিউ ইস্কাটনের জনকণ্ঠ ভবনে ৩ কেজি ওজনের একটি এ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। সেনাবাহিনীর সহায়তায় এটি অপসারণ করা হলে বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় জনকণ্ঠ। বোমা বিশেষজ্ঞরা সেটি উদ্ধার করে নির্জন স্থানে নিয়ে বিস্ফোরণ ঘাটিয়েছিল। ওই বিস্ফোরণ থেকে দেখা গিয়েছিল, বোমাটির দৈনিক জনকণ্ঠে বিস্ফোরণ ঘটলে ভবনটিই ধ্বংস হয়ে যেত। জঙ্গীগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীদের ক্লেদাক্ত স্বরূপ উন্মোচনের কারণেই দৈনিক জনকণ্ঠের ওপর এ ধরনের একের পর এক আঘাত এসেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম দিনেই দৈনিক জনকণ্ঠের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। দ্বিতীয় দিন থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠের সরকারী বিজ্ঞাপন। আর বেসরকারী কোন বিজ্ঞাপন যাতে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হতে না পারে, সে জন্য ওই সময় অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করা হয়েছিল। ওই সেলের কর্মকর্তারা বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানিগুলোকে টেলিফোন করে দৈনিক জনকণ্ঠে বিজ্ঞাপন প্রদান থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এখানেই শেষ নয়। ১/১১ সরকারের আমলেও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের এই কণ্ঠস্বরকে গলাটিপে ধরা হয়েছিল। এই সময়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে কোন কোন মহলের বিরাগভাজন ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাজীবনও ভোগ করতে হয়েছে। এ সময় তাকে একের পর এক মামলায় জর্জরিত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বহু অপচেষ্টা হয়েছে। তার ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত করা, জনকণ্ঠকে দমানোর অনেক অপতৎপরতা চলেছে। কিন্তু আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে কোনভাবেই দমানো যায়নি। এতসব অপতৎপরতা সত্ত্বেও দৈনিক জনকণ্ঠ কখনও তার অবস্থান থেকে পিছপা হয়নি। এটি সম্ভব হয়েছিল অকুতোভয় সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের আপোসহীন সাহসিকতার কারণেই। সত্য প্রকাশে সিংহহৃদয় আতিকউল্লাহ খান মাসুদ কখনও কুণ্ঠাবোধ করেননি। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই একটি উপ-সম্পাদকীয়তে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির গোপন তৎপরতা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের ওই প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার দুর্নীতি প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে উচ্চ আদালতের কাঠগড়ায় পর্যন্ত দাঁড়াতে হয়েছে। তবু সত্য অবস্থান থেকে ফিরে আসেনি জনকণ্ঠ। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে এটিও ছিল বড় মাইল ফলক। হুমকি, ধমকি, মামলার পর মামলা ছাড়াও টাইম বোমা দিয়ে জনকণ্ঠ ভবনটি উড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টায়ও হার মানেনি জনকণ্ঠ। দমে যায়নি কখনও। এর কারণ ছিল সাহসে বলীয়ান পত্রিকাটির সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। তিনি ছিলেন সাহসের বাতিঘর। অপ স্রোতের বিপরীতে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি লড়াই করে গেছেন। তাই তো সৃষ্টিশীলতা ও বহুমাত্রিকতার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসীদের কাছে তিনি যুগ যুগ ধরে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন। আতিকউল্লাহ খান মাসুদের আকস্মিক ও অসময়ে মৃত্যুর পর এ শিল্প পরিবারের চেয়ারম্যান ও জনকণ্ঠের সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তার বিচক্ষণ সহধর্মিণী শামীমা এ খান। তিনিই এখন এ পত্রিকার কর্ণধার। তার নেতৃত্বে দৈনিক জনকণ্ঠ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আবার নতুন উদ্যমে জনকণ্ঠ পথচলা শুরু করেছে। তার নেতৃত্বে সত্য, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে একাত্তরের মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পশ্চাৎপদ উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে সব সময়ে থাকবে সোচ্চার। যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি, বঞ্চনার বিরুদ্ধে থাকবে নির্ভীক। বাঙালীর সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতি লালন, উন্নত সম্ভাবনাময় সোনার বাংলাকে উর্ধে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাবে- এটাই ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জনকণ্ঠের অঙ্গীকার। দৈনিক জনকণ্ঠ এখন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকতায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা চালাচ্ছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে উন্নয়ন সাংবাদিকতায়। বাংলাদেশ এখন স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। নতুন প্রজম্ম এখন ডিজিটাল ও তথ্য প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ এখন এগোচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে। এগুলো মাথায় রেখেই জনকণ্ঠ তার সাংবাদিকতার নীতিতে পরিবর্তন এনেছে। মূল নীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উন্নয়ন সম্ভাবনা, উন্নয়নের সমস্যার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে। নিরন্তর চেষ্টা করছে সাংবাদিকতায় নতুনত্ব আনার। প্রিয় পাঠক, বিগত দিনের মতো আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের যোগ্য সারথি জনকণ্ঠ। ভবিষ্যতেও পাঠককে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। জাগ্রত জনতার কণ্ঠস্বর, নীতির প্রশ্নে আপোসহীন জনকণ্ঠের সঙ্গে থাকুন। আস্থায় রাখুন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভক্ষণে জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে রইল অফুরান শুভেচ্ছা।
×