
শাহীন রহমান ॥ গত বছর বর্ষায়ও বৃষ্টির প্রতীক্ষার অন্ত ছিল না। কিন্তু এ বছর বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয়েছে বৃষ্টির ধারা। এখন পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। এবারের বৃষ্টিপাতে প্রায় তিন দশকে রেকর্ড অতিক্রম করেছে। শুধু অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতই নয়, বছরের শুরু থকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধকল সইতে হচ্ছে। করোনা থেকে শুরু করে, কালবৈশাখী ঝড়, অতি মাত্রায় বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, বজ্রপাতসহ একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে চলেছে। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না এই দুর্যোগ।
বর্ষে মাঘের শেষ ধন্য রাজার পুণ্য দেশ। খনার বচনের এই প্রবাদ বাক্যের মতোই মাঘের শেষে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছিল। মার্চের শুরুতেই শুরু হয় করোনার প্রকোপ। বিশ্বব্যাপী চলা এই সংক্রমণ ভাইরাস এখন বাংলাদেশে মহামারী আকার ধারণ করেছে। এর থেকে রেহাই পাওয়া কোন পন্থাই এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বলতে পারছেন না। এই করোনার প্রভাবকে দেশের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কিন্তু করোনায় থেমে থাকেনি। এপ্রিলে শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়ের প্রকোপ। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী এবারের কালবৈশাখীর ঝড়ের মাত্রা ছিল অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। কালবৈশাখীর মধ্যেই মে মাসে বজ্রপাতের আঘাতে প্রায় প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যুর ঘটনার ঘটেছে। বর্ষার শেষলগ্নে এসেও বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে।
শুধু তাই নয় এবার মে আসে আঘাত হানে এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আমফান। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন শক্তির বিচারের এটি ছিল সুপার সাইক্লোন। ২২০ কিলোমিটার শক্তি নিয়ে দেশের উপকূলে আঘাত হানে। ল-ভ- করে দেয় দেশের উপকূল। আমফান চলে যাওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন প্রাক বর্ষায় এবং বর্ষায় অতিক্রমায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে। মে মাসে আমফান চলে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত এমন দিন পাওয়া যায়নি যেদিন বৃষ্টিপাত হয়নি। তারা জানায় মে থেকে এখন পর্যন্ত সব মাসেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত তিন দশকের রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায় উজানে এবং দেশের ভেতরে অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণেই এবার আগাম বন্যা শুরু হয়। ২৬ জুন থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বন্যার কবলে রয়েছে। অতীতে এত দীর্ঘ সময ধরে বন্যা দেখা যায়নি। যদিও একারের বন্যার ভয়াবহতা তেমন ছিল না। কিন্তু মানুষ প্রায় ২ মাস ধরেই বন্যার পানিতে বন্দী হয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত দেশ সম্পূর্ণরূপে বন্যা মুক্ত হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক ও নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এনামুল হক বলেন, বন্যান সময় চার মাস। এই সময়ে বন্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি এই বন্যাকে স্বাভাবিক বনা হিসেবেই উল্লেখ করেন। তবে তিনি বলেন উপকূলে জোয়ারের পানির উচ্চতা ছিল অস্বাভাবিক। যা আগে দেখা যায়নি।
দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ॥ গত জুনের ২৬ তারিখ থেকে দেশে বন্যা শুরু হয়েছে এখন অবদি তা চলছে। এখন পর্যন্ত দেশ থেকে বন্যা পানি সম্পূর্ণরূপে নেমে যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বর্ষাকালে উজানে এবং দেশের ভেতরে বৃষ্টিপাতের কারণে জুলাইতে বন্যা প্রকোপ শুরু হয়। কিন্তু অতিমাত্রায় বৃষ্টির কারণে এবার আগেই দেশের প্রধান নদীগুলোর পানি অনেক বেড়ে যায়। এবার মে মাসের শেষে এবং জুনের শুরুতেই যমুনায় যে পরিমাণ পানি বেড়ে যায় তা গত ১৯৮৮ সালের পর আর দেখা যায়নি। অতিমাত্রায় বৃষ্টির কারণে আগেই বন্যার কবলে পড়ে দেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চল।
শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাত ॥ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশে উপকূল ঝড় জলোচ্ছ্বাসের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি বছর এখানে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। সাধারণ মে মাসেই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত বেশি আসে। গত বছর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে উপকূল ক্ষয়ক্ষিত হয়। নবেম্বরের আরও একটি ঝড়ের আঘাত হানে। অতীতে একাধিকবার শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে উপকূল। কিন্তু গত ২০ মে যে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ আঘাত হানে শক্তি বিচারের তা ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। প্রায় ২২০ কিলোমিটার শক্তি নিয়ে দেশের উপকূলে আঘাত হানে। শুধু উপকূল নয় এর প্রভাবে সারাদেশে প্রচ- ঝড় বয়ে যায়। উপকূল ল-ভ- করে দিলে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি সারাদেশেই হয়েছে। আমফনের কারণে ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া টাকার অঙ্কের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১১ শ’ কোটির বেশি।
কালবৈশাখী ঝড় ॥ বাংলা প্রথম ঋতু বৈশাখ। বৈশাখ এলেই কালবৈশাখীর ঝড়ের কথা মনে করে দেয়। গ্রীষ্মের শুরুতে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাওয়া এদেশে নতুন নয়। কিন্তু করোনার এই বছরে কালবৈশাখী ঝড়ের দাপট ছিল কয়েকগুণ বেশি। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী এপ্রিলের শুরুতেই কালবৈশাখীর শুরু হয়েছে। মে মাসে এর দাপট বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এবার যে পরিমাণ কালবৈশাখী প্রকৃতিতে আঘাত হেনেছে নিকট অতীতে দেশে কালবৈশাখীর প্রকোপ দেখা যায়নি।