শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বছরে আয় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সারা বিশ্ব থেকে ফেসবুকের মোট রাজস্ব আয় বাংলাদেশী টাকায় দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। আন্তর্জাতিক আয়ের ওপর নির্দিষ্ট হারে কর ও অন্যান্য ব্যয় বাদে এ প্রান্তিকে ফেসবুকের নিট মুনাফার পরিমাণ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫১ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে আয়ের পরিমাণ ফেসবুকের মোট আয়ের পরিমাণ শূন্য দশমিক দুই শতাংশ। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। গত বছর ২০১৯ সালে মাত্র ৩ মাসেই ফেসবুক আয় করেছে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ফেসবুক ইনভেস্টর রিলেশনস ওয়েবসাইট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে ফেসবুক প্রকাশিত ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেসবুকের এ্যাকাউন্ট সংখ্যা বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি কাছাকাছি। বাংলাদেশে শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ২০১৮ সালে আয় করেছিল প্রায় ১৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারকে কর দিয়ে ও বছরে বিনিয়োগ ও অন্যান্য খরচ বাদে তাদের নিট মুনাফা ছিল প্রায় তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফেসবুকের ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় ২৪০ কোটি। যাদের মধ্যে প্রতিদিন সক্রিয় থাকে প্রায় ১৬২ কোটি ব্যবহারকারী। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ফেসবুক ব্যবহারকারীরা কর দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে। অন্য দেশগুলোর ব্যবহারকারীরা সংশ্লিষ্ট ফেসবুক আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে। ১৯৮০ সালে প্রণীত যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য প্রণীত দ্বৈত আইরিশ চুক্তির আওতায় ফেসবুক আয়ারল্যান্ডকে শুধু ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে আন্তর্জাতিক কর দিতে হয়।
পুলিশের সাইবার ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছর ২০১৯ সালে অক্টোবরে প্রকাশিত হয়েছে তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদন থেকে ফেসবুকের আয় ব্যয় সংক্রান্ত খুটিনাটি বিষয়ে তথ্য জানিয়েছে ফেসবুক ইনভেস্টর রিলেশনস ওয়েবসাইট। যুক্তরাষ্ট্রের এই কোম্পানির তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ প্রান্তিকে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবহারকারী প্রতি ফেসবুকের আয় ১৫ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
পুলিশের সাইবার ইউনিট সংগৃহীত তথ্যে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের বিনিয়োগও হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। আয়ও দেখানো হয় কেন্দ্রীভূত হিসেবে। ফলে বিশ্বের সব দেশেই ফেসবুক ব্যবহারকারী থাকলেও এবং সব দেশ থেকেই কম-বেশি আয় হলেও কোন দেশকেই কর দিতে হচ্ছে না ফেসবুককে। ফেসবুকের মতো অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ ও অনলাইন সেবা মাধ্যম গুগল, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, স্নাপচ্যাট, ওটিটি সেবা মাধ্যম হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, ইমো, গুগল ডুয়ো একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত হচ্ছে এবং আয় করছে। তবে এ মুহূর্তে আয় ও সম্পদের স্থিতির হিসেবে এগিয়ে আছে গুগল। দ্বিতীয় স্থানে আছে ফেসবুক।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ও এশিয়ার ১৪টি দেশের পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে তিন বছর আগে ২০১৭ সালে ঢাকায় যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে উপস্থিত ছিলেন ফেসবুক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি। বিক্রম লাংঘে নামক এই প্রতিনিধি ফেসবুকের ব্যবস্থাপক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার কাছে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে তথ্য বিনিময়ে তখন ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া হয়। সেই সম্মেলনে তখন অনেকেরই নজর কেড়েছে এই সম্মেলনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিনিধির যোগদান। সম্মেলনে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি একেএম শহিদুর রহমান বলছিলেন, আমাদের একটা অবজার্ভেশন হচ্ছে, বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী সোশ্যাল বিভিন্ন মিডিয়া ব্যবহার করে তাদের প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। এজন্যই আমরা তাদের নিয়ে আসছি।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে যেসব অপরাধ সংঘটিত করা যায়, সব বিষয়ে তখন আলোচনা হয়। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির কাছ থেকে আমরা তাদের বক্তব্য শুনেছি এবং অপরাধ দমনে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জঙ্গীবাদের প্রচার বন্ধ করার বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে মি. লাংঘের সঙ্গে পুলিশের আলাদা একটি বৈঠকও হয়েছে। ফেসবুকের অপব্যবহার বন্ধ করে অপরাধ দমন বিশেষ করে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, সাইবার অপরাধী কর্মকা- বন্ধে তখন ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টিতে আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু তখন প্রশ্ন উঠেছে, এ ধরনের অপরাধ মোকাবেলায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা প্রস্তুত?
সাইবার ইউনিটের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তিন বছর আগের আন্তর্জাতিক পুলিশ সম্মেলনে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ ফেসবুক প্রতি বছর ঠিকই হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করে নিচ্ছে।