
শাহীন রহমান ॥ সম্প্রতি দেশের দূষণের তালিকায় জোরেশোরে যে নাম আলোচিত হচ্ছে তা হলো প্লাস্টিক দূষণ। এই দূষণের পরিমাণ বেড়ে চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশপাশের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের পরিমাণ অনেক বেশি। দেশে বিশেষ করে কসমেটিকস প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক এবং বাণিজ্যিক কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। প্লাস্টিক দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মৎস্য উৎপাদন এবং পর্যটন খাত। তারা বলছেন, বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের চেয়ে ইথানিলযুক্ত পলিথিন ব্যবহারের পরিমাণ দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি। ছোট থেকে বড় যে কোন পণ্য প্যাকিংয়ে পলিথিনের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবহৃত এইসব পলিথিনের শেষ ঠাঁই হচ্ছে নর্দমা, খাল, নদী প্রভৃতি স্থানে। পলিথিনের অনিয়মিত ব্যবস্থাপনা ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ।
২০১৪ সালের ওয়েস্ট কর্নসানের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশে মাথাপিছু সাড়ে তিন কেজি প্লাস্টিকের ব্যবহার রয়েছে। যদিও পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কায় এই হার ৬ কেজির বেশি। কিন্তু দূষণের দিক দিয়ে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের পরিমাণ বেশি। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক খারাপ হওয়ায় পচনশীল এবং অপচনশীল আলাদা করার সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ নদীমাতৃক এবং ভাটির দেশ হওয়ায় উজানে পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য দেশের নদীগুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পতিত হচ্ছে। ফলে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কম হলেও দূষণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। তারা বলছেন, প্লাস্টিকের এসব বর্জ্যরে ফলে মৎস্য ও পর্যটন খাতে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার তিন শ’ কোটি ডলার।
তারা উল্লেখ করেন মাটির অনুজীব মাটিতে মিশে যাওয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্য পচাতে (ডিকম্পোস) পারে না। এটি আবহাওয়া প্রভাবিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদে ছোট ছোট টুকরো হয়ে বাতাসে বা পানিতে মিশতে থাকে। যা পরবর্তী সময়ে পরিবেশ বা প্রাণিজগতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। সাগর ও নদীতে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে মাছের খাবারের মাধ্যমে মানব দেহেও প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। জলজ প্রাণী এসব খাবার হজম করতে না পেরে মারা যাচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণের প্রভাবে উদ্ভিদ এবং জলজ প্রাণীর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতি হচ্ছে মানব স্বাস্থ্যের। মানবদেহে থায়রয়েডের হরমোন অতিরিক্ত ক্ষরণ এবং বিশেষ করে ক্যান্সার, চর্মরোগ, কিডনি রোগের মতো ভয়াবহ রোগ সৃষ্টির জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী এই প্লাস্টিক বর্জ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বে সমসাময়িক সময়ে অনেকগুলো পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে একটি হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। বর্তমান এই দূষণ ভয়বহ আকার ধারণ করেছে। বিগত ৫০ বছর ধরে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার বিশ্বে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ এই ব্যবহারের দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী ২৬ কোটি টন প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছিল। পৃথিবীতে প্রতিবছর মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার রয়েছে ৬০ কেজি। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোতে এই ব্যবহারের পরিমাণ ১ শ’ কেজির বেশি। বাংলাদেশে মাথাপিছু তিন কেজি ব্যবহার হলে দূষণের পরিমাণ অন্য যেকোন দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
জাতিসংঘের পরিবেশ প্রকল্পের তথ্য মতে উৎপাদিত এবং ব্যবহৃত এসব প্লাস্টিকের ২২ থেকে ৪৩ শতাংশ নির্দিষ্ট জায়গায় ডাম্পিং করা হয়। বাকি সব প্লাস্টিকের স্থান হয় নদী, খাল, সমুদ্র এবং খোলা জায়গায়। ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের তথ্যে দেখা গেছে ১ থেকে ২ কোটি টন প্লাস্টিকের শেষ গন্তব্য হচ্ছে সরাসরি সাগর ও মহাসগরে। যার প্রভাবে বিভিন্ন দেশের সাগর প্লাস্টিক দ্বারা দূষিত হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কারণে বঙ্গোপসাগর প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উজান থেকে নেমে আসা ৯০ ভাগ পানি পরিবহন করছে বাংলাদেশ। এই পানির বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সরাসরি সাগরে পড়ছে। উজানে বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ভারত, নেপাল এবং অন্য দেশগুলোর ব্যবহৃত প্লাস্টিক দেশের নদীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পতিত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের উৎপাদিত মাছের একটি বড় অংশ বঙ্গোপসাগর থেকে আসে।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার এক তথ্যে বলা হয়েছে রাজধানী ঢাকায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশ গবেষক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, মাটির অনুজীব মাটিতে মিশে যাওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য পচাতে (ডিকম্পোস) পারে না। এটি আবহাওয়া প্রভাবিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদে ছোট ছোট টুকরো হয়ে বাতাসে বা পানিতে মিশতে থাকে। যা পরবর্তী সময়ে পরিবেশ বা প্রাণিজগতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (২০০২ সালের সংশোধিত) ৬ এর (ক) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার যেকোন প্রকার পলিথিন, শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্যকোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি বাজারজাত এবং বিক্রয় ও বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। তারা বলছেন, প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ কমিয়ে আনতে হবে।