ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবি

প্রকাশিত: ০১:৫৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। পাশাপাশি এক ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণারও দাবি সংগঠনের নেতাদের। গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে জাতিসংঘের কাছে প্রমাণপত্র পাঠানোর ঘোষণাও দেয়া হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। তবে বিভিন্ন দেশে গণহত্যার তথ্য প্রমাণ পাঠানোর ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সহযোগিতা না করারও অভিযোগ করেন কমিটির নেতারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচারের দাবিও জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকসহ শহীদ সন্তানরা। বুধবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ৯৪ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা-৬ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। স্মারক বক্তৃতা পাঠ করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মফিদুল হক। ‘বাংলাদেশের গণহত্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব বিষয় ওঠে আসে। আলোচনায় অংশ নেন সরকারের মন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, বিচারপতি ও বিশিষ্টজনরা। রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন ও এক ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালনে জাতীয় সংসদসহ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২৫ মার্চকে গণ্যহত্যা দিবস হিসেবে পালন না করার কোন কারণ আমি পাই না। তাছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে যেসব ঘটনা ঘটেছিল এর জ্বলন্ত সাক্ষী আমি। সেদিন রাতে আমি আর ফজলুল হক মনি মতিঝিলের একটি বাসায় পালিয়ে ছিলাম। তারা কি রকম বর্বরতা চালিয়েছে তা আমার জানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও বিভিষীকাময় অত্যাচার হয়েছে তা গোটা পৃথিবীর মানুষ জানে। এমন বাস্তবতায় গণহত্রা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে তিনি প্রধানমস্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা বলেন, আমরা এক ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করতে পারি। চলমান সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কথা উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আজকে দেশজুড়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তৎপরতার মতো পরিস্থিতির মূলে রয়েছেন জিয়াউর রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থাকলেও প্রকৃতঅর্থে দেশপ্রেমিক ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের কথিত পক্ষের লোকদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখা গেছে জাতির জনক হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নিতে। তাদের মধ্যে ডালিম, রশিদসহ অনেকেই রয়েছেন। স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধে আঘাত এনেছিলেন জিয়াউর রহমান এমন মন্তব্য করে তোফায়েল বলেন, ২৫ মার্চে গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে এজন্য যা যা করা দরকার তাই করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তোফায়েল। ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন সময়ে বিজয় পর্যন্ত আলোচনা হয়। গণহত্যাকে কখনই গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ৩০ বছর বিএনপি, জামায়াতসহ জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকতে গণহত্যার বিষয়টি সামনে আনা যায়নি। সময় পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের সবাইকে এখন মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কমপক্ষে পাঁচ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এমন দাবি করে তিনি বলেন, এ নিয়ে নানা রকম হিসাব রয়েছে। আমি মনে করি রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী নির্যাতনের সংখ্যা কম উল্লেখ হয়েছে। তিনি বলেন, গণহত্যার বিষয়টি যখন সামনেবড় হয়ে দাঁড়াবে অখন বিশ্ব সম্প্রদায় আমাদের সমর্থন দেবে। এজন্য সরকারকে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতে হবে। যদিও সরকারের মধ্যে কেউ কেউ গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিরোধীতা করবেন। দেশে এখন হাত ধোয়া দিসব পালন হলেও গণহত্যা দিবস পালন হয় না একথা উল্লেখ করে মামুন বলেন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশে গণহত্যার প্রমাণপত্র পাঠাতে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় পাকিস্তানের সংসদে উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাব আইএসআই এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। আমি মনে করি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এর নিন্দা জানানো উচিত। পাশাপাশি পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশে ক্ষতিপূরণ দাবি করা উচিত। সরকারের কাছে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এক ডিসেম্বর অথবা যে কোন দিনকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করা যেতে পারে। বিশ্বের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যার বিষয়টি পড়ানো হয় এমন তথ্য জানিয়ে ইতিহাসবীদ মামুন বলেন, আর কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত করারও দাবি জানান তিনি। পাঠ্যসূচীতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন ইতিহাস পড়ানো হয় না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না পড়ালে কিসের ইতিহাস পড়াবেন। হেফাজতের দাবিতে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতাকরণ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত, জামায়াত নিষিদ্ধের আইন কেন মন্ত্রীসভায় ওঠে না এটা চিন্তার বিষয়। জামায়াত ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ একসাথে চলতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত বৃটিশ সমাজকর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে কি ঘটেছিল এটি কারো অজানা নয়। আমি মনেকরি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এখনই কাজ শুরু করা উচিত। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত। এ সম্পর্কিত তথ্য উপাত্তও আমার কাছে রয়েছে। শহীদসন্তান ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবাকে গুলি করা হয়েছিল। এর আগে সৈনিকরা তাকে জিঞ্জেস করেছিল, তোমার নাম ও ধর্ম কি। তার মানে হলো ধর্মীয় ভাবেও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। তবে ১৯৭১ সালে গণহত্যা যে চালানো হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের দাবি জানান। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা-লীর সভাপতি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। আলোচনায় অংশ নেন, এ্যাটর্নী ইউলিয়াম স্লোন প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন শহীদ সন্তান ও অভিনেত্রী শমী কায়সার।
×