অনেকের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না
ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি স্বাস্থ্য খাতে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি
নিখিল মানখিন ॥ ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করছে না স্বাস্থ্য খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। কর্মস্থলে স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে এই পদ্ধতি চালু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এই পদ্ধতি চালু করা হয়নি। এই মেশিন স্থাপন করা হয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেও নিয়মিত উপস্থিতির তথ্য পাঠানো হচ্ছে না। ফলে অনেক চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী ও কর্মকর্তার কর্মস্থলে উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার দেশের সাতটি বিভাগে মেশিন স্থাপন করা হয়েছে এমন ৪৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৩৮টি প্রতিষ্ঠান তথ্য প্রেরণ করেছে। পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, গড়ে শতকরা ৬০ ভাগ চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারী অনুপস্থিত।
কর্মস্থলে স্বাস্থ্য সেক্টরের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত উদ্যোগসমূহ সফল না হওয়ায় ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি চালু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নিয়মিত উপস্থিত নিশ্চিত করতে সিভিল সার্জনদের আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কোন অভিযোগ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যাহত হতে পারে এমন কোন পরিস্থিতি বরদাশ্ত করা হবে না। যে সিভিল সার্জন তার অধীন চিকিৎসকদের গাফিলাতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন না তাকেও জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ আজ যে কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক এক দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কার্যক্রম। তিনি বলেন, এই ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও দক্ষ করে তুলতে মাঠ পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ প্রোভাইডারদের আরও মনোযোগী ও সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত ক্লিনিকে থেকে সেবা না দেয়ার কোন অভিযোগ পেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের স্বাস্থ্য সেবা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশংসা কুড়াচ্ছে তাকে আরও উর্ধে তুলে ধরতে সকলকে কাজ করতে হবে বলে জানিয়ে দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি ঢাকা বিভাগে ১২০টি প্রতিষ্ঠানে, বরিশাল বিভাগে ৩১টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৪টি, খুলনা বিভাগে ৫৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৫২টি, রংপুরে বিভাগে ৫৪টি ও সিলেট বিভাগে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানে বসানো রয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার ঢাকা বিভাগের ৭৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগের ৩৭টি, বরিশাল বিভাগের ১৯টি, খুলনা বিভাগের ৩৪টি, রাজশাহী বিভাগের ২৪টি, রংপুর বিভাগের ২৪টি ও সিলেটে বিভাগের ৩৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে উপস্থিতি তথ্য পাঠানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই স্বাস্থ্য সেক্টরের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিশ্চিতকল্পে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৩ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক স্বয়ং দেশের প্রায় ৬ হাজার চিকিৎসককে কর্মস্থলে না পাওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসকদের উপস্থিতি সরেজমিনে দেখতে ১০ সদস্যের আকস্মিক পরিদর্শন টিম গঠন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সদস্য করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর কয়েকটি অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে কমিটির অভিযানে নেমে আসে স্থবিরতা। অনেক সরকারী চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও কর্মস্থলে সঠিক সময়ে উপস্থিত না হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, কার্যদিবসে অনেক সরকারী মেডিক্যাল শিক্ষক বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কাজ করে থাকেন। দিনে নামমাত্র সময় দিয়ে থাকেন তারা। দেশের বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর সাইনবোর্ডে ছেয়ে গেছে সরকারী চিকিৎসকদের নাম। নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পাশাপাশি সরকার হাসপাতালের রোগী নিজেদের চুক্তিবদ্ধ চিকিৎসালয়ে ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক সরকারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। অনেক চিকিৎসক তদ্বির চালিয়ে অবস্থান করছেন নিজেদের সুবিধাজনক এলাকায়। জেলা, এমনকি বিভাগীয় কার্যালয়ে তাদের অনেকে দায়িত্ব পালন করছেন। যোগদান করার পরই কর্মস্থলে অনেকের দেখা নাই। তাদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি পরিপত্রে বলা হয়েছে, কর্মস্থলে চিকিৎসকদের ইলেকট্রনিক হাজিরা মনিটরিং করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বায়োমেট্রিক মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপিত মেশিনে চিকিৎসকদের ইলেকট্রনিক্স হাজিরা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘বায়োমেট্রিক মেশিন কোন সময় অচল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে বলে জানানো হয় পরিপত্রে।
পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথমে দেশের কিছুসংখ্যক সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বায়োমেট্রিক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। তখন চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিতে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্থাপিত বায়োমেট্রিক মেশিন নষ্ট করার অভিযোগ তুলেছিল খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরেকটি আদেশ পাঠানো হয় সিভিল সার্জন এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের কাছে। এতে বলা হয়, সম্প্রতি দেশের সব সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো এক আদেশে নিজ নিজ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে হাজিরা মনিটরিংয়ের জন্য স্থাপিত বায়োমেট্রিক মেশিন নষ্ট করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে তিন কর্মদিবসের মধ্যে অধিদফতরকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু নির্দেশ অনুযায়ী সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কোন তথ্যই পাঠাননি।
এ অবস্থায় আরও দুই কর্মদিবস সময় বেঁধে দিয়ে ওই সব যন্ত্র নষ্টের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া এবং আগের নির্দেশ কেন কার্যকর হয়নি তা ব্যাখ্যাসহ জানাতে বলা হয়। তা না হলে যে কর্মকর্তারা তথ্য পাঠাননি, তাদের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছিল ওই চিঠিতে। কিন্তু তাতেও সাড়া না পেয়ে দেশের সব সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বায়োমেট্রিক স্থাপন এবং তা সংরক্ষণে পরিপত্র জারি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।