
‘Untamed ’ মানে অদম্য। যিনি এখনো পোষ মানেননি। Stop pleasing, Start living। সঙ্গে যিনি অন্যকে খুশি না করে বাঁচতে শিখেছেন, বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন। Untamed গ্লেনন ডয়েলের আত্ম-আবিষ্কার এবং মুক্তির দিকে যাত্রার এক গল্পের কথা। এ গল্প জীবনের গল্প, এ গল্প কখনো কখনো প্রতিদিনের গল্প।
বইটিতে আছে গ্লেননের জীবনের ব্যক্তিগত উপাখ্যান এবং প্রতিচ্ছবিগুলোর একটি সিরিজ। ডয়েল তার লেখার মধ্য দিয়ে সামাজিক প্রত্যাশা এবং তার ভেতরে বয়ে চলা অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসগুলোর মধ্যে একটা অনুসন্ধান করে দেখেছেন- কি তাকে আটকে রেখেছে এবং কিভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত এই সীমাবদ্ধতাগুলো প্রত্যাখ্যান করে একটি খাটি এবং পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে শিখেছিলেন। চারপাশের মিথ্যাকে অতিক্রম করে সত্যকে নিজের ভেতরে যেটুকু দেখতে পেয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে বাঁচতে শিখেছিলেন। সেই বাঁচা এবং লড়াইয়ের কথাই ডয়েল Untamed এ বর্ণনা করে গেছেন। এ এক আত্ম-যুদ্ধ, এ এক নিজের সঙ্গে বাইরের যুদ্ধ, বাইরের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ।
বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনেকগুলো দিকের মধ্যে একটি হলো ডয়েলের সততা। খাঁটি এবং মুক্ত। সাজানো পাকা হয়ে ওঠেনি সেই অর্থে কাঁচা। অসততাটুকুর মুখোশ পরেনি বলে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে গেলে মনে হয় দুর্বল। কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন- নির্ভীকভাবে চললে যা অন্যের চোখে দুর্বল এবং কাঁচা, তার নিজের জন্য হয়ে ওঠে সবল এবং পাকা। জীবন পথে চলতে চলতে অ্যাডিকশন, বিশ্বাসঘাতকতা এবং শরীরের মধ্য দিয়ে কি করে কতগুলো কঠিন বিষয়কে মোকাবিলা করেছিলেন, সেগুলোকে নিজের অস্বস্তিকর অনুভূতির মধ্যে কিভাবে গভীরভাবে সম্পর্কিত করেছেন, তার এক সুনিপুণ বর্ণনা তিনি দিয়ে গেছেন বইটিতে।
লেখার প্রতি নিষ্ঠা, অনুভূতির প্রতি সততা এবং জীবনের প্রতি খাটি দৃষ্টি, এমন বিষয়গুলোই পাঠকদের সঙ্গে গভীর স্তরে তার একটি সংযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়। একজন সমাজকর্মী হিসেবে লেখক সত্তার পাশাপাশি নিজের অনুভূতির বয়ান দিতে গিয়ে তিনি কেবল নিজের জন্যই লেখেননি, অন্য হাজার হাজার নারীর জন্যও লিখেছেন, যারা এই ধরনের সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
গ্লেনন ডয়েল একজন আমেরিকান লেখক, সমাজকর্মী এবং সমাজসেবী। তার বহুল পরিচিত বইয়ের মধ্যে ক্যারি অন, ওয়ারিয়র এবং লাভ ওয়ারিয়ার আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ সুপরিচিত। বেশিরভাগ বইগুলোতেই তিনি অ্যাডিকশন, ট্রমা এবং সেখান থেকে কি করে বের হয়ে আসা যায়, এমন সব থিমগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। একই সঙ্গে টুগেদার রাইসিং নামক একটি অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। যারা পৃথিবীজুড়ে সামাজিক খাতে পরিবার এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় যখন সংকটের মুখোমুখি হয়, তাদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করে এই প্রতিষ্ঠান। তার প্রতিষ্ঠান এবং লেখার মাধ্যমে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার ও সমতার কথা বার বার বলেন। একজন ভালো বক্তা হিসেবে এবং ভালো লেখক ও সমাজকর্মী হিসেবে নিউইয়র্ক টাইমসের চোখে সময় সময়ে সেরা লেখকের তকমাও পেয়েছেন। তিনি একাধারে লেখক, সমাজকর্মী, কখনো প্রতিবাদকারী, অ্যাক্টিভিস্ট, কখনো একজনের স্ত্রী, কখনো কারো মা, কখনো প্রতিবাদী নারী, কখনো কেবল উচ্চ কণ্ঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন মানুষ।
বইটি জুড়ে অনেকগুলো থিম রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি থিম হলো বিভিন্ন উপায়ে সমাজ কি করে নারীদের গঠন এবং নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা। সমস্যাগুলো বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ব্যক্তিগতভাবে তিনি কিভাবে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য অনেক নারীরও কিংবা একজন মহিলার কেমন হওয়া উচিত, তার সঙ্গে একটি পূর্বনির্ধারিত ছাঁচে ফিট করার জন্য সমাজের যে চাপ এবং চাহিদা থাকে, তার বিপক্ষে তার সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা এবং চাহিদাগুলোকে সামনে এনে সামাজিক শর্তগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে বাঁচতে হয়, তার এক দীর্ঘ সংগ্রামের কথা।
তিনি নারীদের ঐতিহ্যগত লিঙ্গ ভূমিকা মেনে চলার সামাজিক চাপ এবং সেই সঙ্গে নিজের চেয়ে অন্যের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেওয়া বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিকোণকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজে কিভাবে সেই বিরক্তি এবং অপূর্ণতার অনুভূতি থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতা এবং মুক্তির পথে বাঁচতে শিখেছিলেন, বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং সেই বাঁচার পথে অন্য নারীদেরও সংগ্রাম করার কথা বলেছেন।
ডয়েল আমেরিকার গ্রামীণ ভার্জিনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শহর থেকে দূরে গ্রামীণ পরিবেশে তার বড় হওয়া। তবে অন্য অনেক ব্রোকেন ফ্যামিলির মতো অ্যাডিকশন, মানসিক অসুস্থতা এবং ট্রমাসহ এমন কিছু সমস্যায় আক্রান্ত পরিবারের পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন। এতসব বাধা থাকা সত্ত্বেও তিনি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে পরবর্তীতে সামাজিক কাজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ডয়েল যুক্তি দেন যে, নারীদের কেবল নারী থাকার যে সামাজিক চাপ তা কি করে ব্যক্তিগত সুখের জন্য ক্ষতিকর হয় এবং সেটি যে সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্যও ক্ষতিকর, তার কথা বলেন। নারীদের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে দমিয়ে রাখার মাধ্যমে সমাজ তার জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মূল্যবান অবদান এবং ধারণা থেকে সমাজকেই বঞ্চিত করে। জীবন পথে অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি নারীদের তাদের নিজেদের ইচ্ছাকে আলিঙ্গন করার জন্য এবং সামাজিক প্রত্যাশাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন, যা তাদের আটকে রেখেছে সামাজিক বেষ্টনীতে। সেই বেষ্টন ভেঙে তাদের নিজেদের অদম্য করার এবং আরও খাটি জীবন উদ্যাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন বইটিতে।
বইটির আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো ডয়েল যেভাবে সেখানে ব্যক্তিগত আখ্যান এবং সামাজিক বিশ্লেষণকে একত্রিত করেছেন। তিনি দক্ষতার সঙ্গে তার নিজের অভিজ্ঞতা এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে হেঁটে হেঁটে উভয়ের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করেন এবং দেখান যে কিভাবে তার নিজের সংগ্রামগুলো এই বিস্তৃত বিষয়গুলোর প্রতিফলন করে। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে তার সমস্যাগুলোর সমাধানের একটি সংক্ষিপ্ত এবং বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় প্রকৃতির সম্ভাব্য সমাধানগুলোর একটি সংযোগ তৈরি করে আলোর পথ দেখায়।
কিছু কিছু সমালোচকদের মতে বইটির একটি সম্ভাব্য সমালোচনা হলো যে ডয়েলের কিছু সমাধান এমন করে মাঝে মাঝে অত্যধিক সরল মনে হতে পারে পাঠকের কাছে। কারণ জীবন অনেক জটিল। যদিও তার এই সরলতার অন্তরালে থাকে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টির দিকে চোখ ফেরানো এবং সে অনুযায়ী পাঠকদের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেন। মাঝে মাঝে লেখার শৈলী সংবেদনশীল হলেও মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি যে বিষয়গুলোকে অবলম্বন করে তার সেই আবেগ প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন, সেগুলো উদ্দেশ্যমূলক হওয়ার পরিবর্তে বরং বিশ্লেষণের আলোকের কারণে সত্যিকার পরামর্শ হয়ে ওঠে।
সামগ্রিকভাবে Untamed একটি চিন্তা-উদ্দীপক এবং উৎসাহ দানকারী পঠন, যা অনেক পাঠকের মধ্যে আত্ম-বিশ্লেষণ এর সঙ্গে সঙ্গে অনুপ্রাণিত করে তাদের। তার সততা এবং গল্প বলার টেকনিক নারীদের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং সীমাবদ্ধতাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে একটি সরল, খাঁটি এবং সৎ জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। যদিও কেউ কেউ তার লেখার স্টাইলটিকে মাঝে মাঝে খুব আবেগপ্রবণ বলে মনে করতে পারে, কিন্তু তিনি যে মেসেজটি দিতে চেয়েছেন, তার শক্তি এবং গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
প্যানেল