ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ জুন ২০২৫, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘মুসলিম রেনেসাঁ’র কবি ফররুখ আহমদের জন্মদিন আজ

শেখ ফরিদ

প্রকাশিত: ০৮:১১, ১০ জুন ২০২৫

‘মুসলিম রেনেসাঁ’র কবি ফররুখ আহমদের জন্মদিন আজ

ছবি: সংগৃহীত

আজ ১০ জুন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। আজকের দিনে জন্মেছিলেন ফররুখ আহমদ—একজন কবি, চিন্তক এবং আত্মমর্যাদাশীল মুসলিম সমাজের কণ্ঠস্বর। যাঁর কলমে ইসলামি চেতনা আর বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট উঠে এসেছিল ব্যতিক্রমী শক্তি ও স্পষ্টতায়। বাংলা কাব্যধারায় তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন পথ—এক ঐতিহাসিক সাহিত্যিক আন্দোলনের চেহারা, যাকে আমরা বলি ‘মুসলিম রেনেসাঁ’।

শৈশব, শিক্ষা ও মানসগঠন
১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি ফররুখ আহমদ। পিতা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন।

কিন্তু তাঁর মন পড়ে ছিল সাহিত্যে, চিন্তায় ও স্বপ্নে। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতি ও সামাজিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে। সাহিত্যচর্চার সূচনা কলেজ জীবনেই। ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর লেখা কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেতে শুরু করে।

কবিতা যেখানে আত্মপরিচয়ের বিপ্লব
ফররুখ আহমদের কাব্যজগৎ বিচিত্র, তবে তার কেন্দ্রে ছিল—ইসলামী মূল্যবোধ, আত্মিক জাগরণ, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা। তাঁর কবিতা যেন এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতিসত্তার জন্য চেতনাদীপ্ত যুদ্ধ।

বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলায় যেখানে অনেক কবি পাশ্চাত্য আধুনিকতা ও নিঃসঙ্গতার দিকে ঝুঁকছিলেন, ফররুখ আহমদ সেখানে দাঁড় করান এক ধর্মনিষ্ঠ ও সংগ্রামী কাব্যবোধ।

তিনি নিজেই বলেন— আমার কাব্যচিন্তা আর কিছুই নয়, এক ঈমানদীপ্ত অভিযাত্রা। আমি চাই আমার কবিতা যেন মানুষের ভিতর বিশ্বাস জাগায়, আত্মবিশ্বাস গড়ায়।

বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ও অনন্য কীর্তি
ফররুখ আহমদের গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:

সাত সাগরের মাঝি

নৌফেল ও হায়াত

সিরাজাম মুনীরা

পাক সার জমিন

ধর্মের কল

সানাই

হাতেম তায়ী

মুহূর্তের কবিতা

বিষের বাঁশি

তার ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে আধ্যাত্মিক রূপকথার মতো চিরভাস্বর। এই বইয়ের নায়কের যাত্রা কেবল ভৌগোলিক নয়—এটা এক আত্মার জাগরণ, এক জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

সাহিত্যচর্চার বাইরে জীবনসংগ্রাম
কবির জীবন ছিল নানা টানাপোড়েনে ভরা। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি সরকারি চাকরি করেননি। কিছুদিন ‘প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট’-এ কাজ করেন, তবে স্থায়ীভাবে সাহিত্যেই যুক্ত ছিলেন। লেখালেখি করে সংসার চালানো কঠিন হলেও তিনি কখনো আপোষ করেননি। ইসলামী আদর্শচ্যুতি ও সংস্কৃতি-বিমুখ চিন্তাধারার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অটল।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি
ফররুখ আহমদের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি পেয়েছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

বাংলা একাডেমি পুরস্কার
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
একুশে পদক (মরণোত্তর)
মাইকেল মধুসূদন পদক

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন ফররুখ আহমদ। কিন্তু তাঁর সাহিত্যিক উত্তরাধিকার আজও আমাদের চেতনাজগতে আলো জ্বালায়। তাঁর কবিতা কেবল কাগজে লেখা কিছু ছন্দ নয়—সেগুলো জাগরণের অস্ত্র, আত্মবিশ্বাসের মশাল, ঈমানি সাহসের গান।

আজকের প্রাসঙ্গিকতা
এই সময়ে, যখন আমরা নিজেদের সাংস্কৃতিক চেতনা ও আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, তখন ফররুখ আহমদ যেন ফিরে ফিরে আসেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি পংক্তি যেন এক প্রজন্মকে প্রশ্ন করে—

“তোমার বিশ্বাস কোথায়? তুমি কী হয়ে উঠতে চাও?”

আজ ফররুখ আহমদের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। বাংলা সাহিত্যে তিনি শুধু একজন কবি নন—একটি ভাবধারার নাম, এক আন্দোলনের প্রতীক। তাঁর কবিতায় এখনো ঘুম ভাঙে অগণিত তরুণের, তাঁর ভাষায় এখনো বেঁচে থাকে এক নতুন দিনের স্বপ্ন।

ফরিদ 

×