ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

তাণ্ডব সিনেমার ‘লিচুর বাগানে’ গান : লোকসঙ্গীতের বিকৃতি

ফজলে রাব্বি

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ১০ জুন ২০২৫; আপডেট: ০০:৫২, ১০ জুন ২০২৫

তাণ্ডব সিনেমার ‘লিচুর বাগানে’ গান : লোকসঙ্গীতের বিকৃতি

বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত তার বৈচিত্র্য, আবেগ ও আধ্যাত্মিকতার জন্য বিশ্বব্যাপী অনন্য। এরই একটি বিশেষ ধারা হলো ঘেটু গান, যা মূলত হাওরাঞ্চলের সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল উপাদান। কিন্তু সম্প্রতি লোকগানের বিকৃত রূপ ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এই ঐতিহ্যবাহী সংগীতের মর্যাদা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আলোচনায় উঠে এসেছে সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘তাণ্ডব’-এ ব্যবহৃত ‘লিচুর বাগানে’ গানটি, যা ঘেটু গানের ঐতিহ্যকে রিমিক্সের নামে পরিবর্তন করে উপস্থাপন করেছে।

ঘেটু গান: একটি সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গি

ঘেটু গান কেবল গান নয়, এটি হাওর অঞ্চলের একটি জীবন্ত লোকসংস্কৃতি। কিশোর ছেলেদের নারী সাজে উপস্থাপন করে গাওয়া এই গানগুলি সমাজে নানা মাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও, এর অন্তর্নিহিত ভাব ও গীতিকলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই ধারায় প্রধানত দেহতত্ত্ব, প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার মিশেল ঘটে।

এধরনের গান যে কেবল গ্রামীণ আনন্দের উৎস ছিল তা নয়—এটি ছিল সমাজ-সংসারের একধরনের প্রতিবিম্ব।

তাণ্ডব সিনেমা ও ‘লিচুর বাগানে’ গান: বিকৃত উপস্থাপনা

সিনেমাটিতে ব্যবহৃত ‘লিচুর বাগানে’ গানটি মূলত লোকগীতিকার সাত্তার পাগলের রচনা বলে স্থানীয় ও গবেষকদের দাবী। কিন্তু গানটির রিমিক্স সংস্করণে মূল গানের আবেগ ও প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে, নৃত্য-সংগীতনির্ভর একটি দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে। মূল গানের ঘেটু সংস্কৃতির যে জটিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ, তা এখানে অনুপস্থিত।

এই উপস্থাপনায় শুধু গানটির গঠন ও সুর নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত সাংস্কৃতিক প্রতীকী অর্থও বিকৃত হয়েছে।

একজন লোকসংগীত গবেষকের ভাষায়,

“ঘেটু গানের মূল বক্তব্যের বাইরে গিয়ে যদি শুধু সুর বা কিছু পংক্তি নিয়ে বানিজ্যিকীকরণ করা হয়, সেটা হচ্ছে ঐতিহ্যকে চুরি ও বিকৃতি করা। এর মাধ্যমে শুধু গান নয়, একটি সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।”

কপিরাইট না থাকার ভয়াবহতা

বাংলাদেশে অধিকাংশ লোকগান এখনও কপিরাইট সংরক্ষণের আওতায় নেই। ফলে, গীতিকার বা তাদের উত্তরাধিকারীদের অনুমতি ছাড়াই এসব গান রিমিক্স ও পুনঃব্যবহার করা হয়।

যদি সাত্তার পাগলের গানটি কপিরাইট সংরক্ষিত থাকত, তবে সিনেমা প্রযোজকদের এই গান ব্যবহারের জন্য অনুমতি নিতে হতো এবং হয়তো গানের প্রকৃত রূপও সংরক্ষিত থাকত।

লোকসঙ্গীতের ভবিষ্যৎ রক্ষায় করণীয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি সরকার, গবেষক ও সংস্কৃতি প্রেমীরা একসঙ্গে উদ্যোগ না নেন, তাহলে আমাদের গ্রামীণ সংগীতের অনেক শাখা বিকৃত ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

প্রস্তাবিত কিছু পদক্ষেপ:

  • লোকগানের ডিজিটাল আর্কাইভ ও কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন শুরু করা
  • লোকশিল্পী ও গীতিকারদের তথ্য নথিভুক্ত করে ঐতিহ্য সংরক্ষণ
  • বাণিজ্যিক ব্যবহারে নির্দেশিকা ও শর্তাবলী তৈরি
  • গবেষণা তহবিল ও ডকুমেন্টেশন প্রকল্প চালু

 

লোকসঙ্গীত চুরি নয়, সংরক্ষণের দাবি রাখে। আর ঘেটু গান শুধু নাচ নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, একটি কাহিনি—যা আমাদের হাওর অঞ্চলের জীবনের ভাষ্য বহন করে। ‘লিচুর বাগানে’ যদি সঠিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহার না হয়, তাহলে সেটি কেবল গান নয়, ইতিহাসের বিকৃতি।

পৃথী

×