ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হাড় আমার, চামড়া–মাংস আপনার, স্মৃতির মনিকোঠায় প্রাথমিক স্কুল

সোহেল রানা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পাবনা সদর

প্রকাশিত: ০০:১১, ৫ জুন ২০২৫

হাড় আমার, চামড়া–মাংস আপনার, স্মৃতির মনিকোঠায় প্রাথমিক স্কুল

ছবি: সংগৃহীত

হাড় আমার চামড়া মাংস আপনার। ছোট খাটো একটা রিমান্ড হলো, সজারে একটা চড় কসিয়ে দিলেন জালাল স্যার৷ তার হাতের পাঁচটা আঙ্গুল আমার বাম গালে ছাপ পড়ে গেলো। চিৎকার ছাড়া তো গতি নাই দিলাম হাউমাউ করে চিৎকার যেন আর একটা চড় না খেতে হয়।

রক্ত রাঙা চোখ, ভয়ানক চেহারা করতে একটু সময়ও নিতো না। কলম দিয়ে মেরে রক্ত বের করে দিলো আমার পাশে বসা সুমন নামের ছেলে। কিন্তু সবাই মিলে দোসটা আমাকে দিলো। আমি পড়াশোনায় যেমন খুব একটা ভালো ছিলাম না, তেমনি প্রমান জোগাড় করতে না পেরে সোজা স্কুলের অফিস রুমে।

চড় খেয়ে কান্না করতে করতে বাসায় আসলাম, মা আমাকে নিয়ে স্কুলে গেলো স্যারকে গিয়ে বললো ও কি কলম মেরেছে? স্যার বললো হ্যাঁ কলম মেরেছে কিন্তু আমি আবারো প্রমান দিতে ব্যর্থ মা স্যারকে বললো আপনার কাছে দিয়ে গেলাম হাড় আমার চামড়া আর মাংস আপনার। কি ভাবে মানুষ করতে হয় বদমাইশকে মানুষ করবেন।

আমি স্কুলে থেকে গেলাম, উপায় না পেয়ে কান্না থামিয়ে দিলাম, শেষ বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। ক্লাস নিতে আসলো রওসনারা ম্যাডাম আমার পড়া হয়নি একটু চালাকি করে যে গালে স্যার চড় দিয়ে ছিলেন সেই গাল ধরে বসে রইলাম। একটু ব্যথা ব্যথা ভাব করলাম কিন্তু সেই চালকিতে কাজ হলো না, সোজা স্কুলের বারান্দায় নিল ডাউন। স্কুলের চারপাশ ছিলো ফাঁকা, রাস্তার সকল মানুষ দেখে নিলো আমাদের। আমি, আশিক, সাদ্দাম, ইকবাল, খাইরুল ছিলাম এই কাতারে।

সে সময় কলমের হেড থাকতো না আমাদের কলমের সাথে, কারো সাথে কিছু হলেই কলম মেরে দেওয়া ছিলো একটা বিশেষ কাজ। ৩ টাকা দামের কলম উল্টা দিক করে রাখলেই কালি বের হয়ে শার্টের পকেট ও প্যান্টের পকেটে দাগ লেগে নস্ট হয়ে যেতো। অবশ্য তখন প্যান্ট পরা আর না পরা প্রায় একই রকম ছিলো।

এত ক্লাস পড়ি নাই সরাসরি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি প্লে, নার্সারী, কেজিতে পড়ার কোন দরকার নাই শুধু শুধু তিন বছর লস করে কি লাভ। মাকে এমন বুঝিয়ে দিলো কিছু মানুষ মা ভর্তি করলো সরাসরি ওয়ানে কি আর করা নিল ডাউন তো আমারই করতে হবে নাকি পাড়ার মানুষ করবে। যেসব ছেলে-মেয়েরা পারদর্শী হয়ে আসছে তাদের ধারেও আমি নাই।

কাঁকরকাটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছি। জরাজীর্ণ স্কুলের সেই ক্লাস সেই সময় এখনো মনে দাগ কেটে আছে মনে পরে হামিদ স্যার, নজরুল স্যার , জালাল স্যার, রওসনারা ম্যাডামের কথা। কয়েকদিন হামিদ স্যার বেঞ্চের নিচে মাথা দিয়ে পাঁচায় ওরাধূরা কাঁচা কুনশির লাঠি দিয়ে মেরে খায়েশ মিটিয়েছে, পড়া না পারলে তো এখনকার সময়ের ছাত্রদের মতো আদরের সহিত বলা হতো না। আগে মার দেওয়া হতো, তারপর কথা। আমাদের সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্যার বা প্রতিষ্ঠান যা সঠিক মনে করতেন সেটাই কার্যকর হতো। এখন একটু আলাদা অনেকের মতামত নেওয়া হয়।

জালাল স্যার ২০২৪ সালের মার্চ মাসে আমাদের বাসায় এসেছিলো অনক দিন পর দেখা বললো বয়স হয়েছে তোরা তো দেখতে যাস না, আমিই তোদের দেখতে আসলাম। খুবই খুশি হয়েছিলাম স্যারের কথা শুনে বর্তমান কি করছি স্যার শুনলো, মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে চলে গেলো।

প্রাইমারি স্কুলের শাহিন, মিজান, আশিক, সাদ্দাম, খাইরুল, ইসরাফিল, রুবিয়া, ময়না, মাছুমা, রিমা ছিলো মেধাবী ছাত্র। শাহিন আমার প্রাইমারি স্কু্লের প্রিয়বন্ধু ছিলো এখন দেখা হলেও কথা হয় না, সবাই ব্যস্ত, আর মিজানের বাসা আমার বাসা পাশাপাশি তবুও দেখা হয়েও যেন হয় না৷

খুব মনে পরে সেই প্রাইমারি স্কুলের স্মৃতি, খুবই মনে পরে কাঁকার কাটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

খুশির খবর স্কুলটি বেসরকারি থেকে এখন সরকারি হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সময়ের মতো নেই কোন পড়াশোনার তোরজোর। বার্ষিক বনভোজন, খেলাধূলায় নেই আগের মতো শোরগোল। হৈ হৈ হয় না মাঠ সাজে না নতুন নতুন রঙিন কাগজে।

আমাদের জালাল স্যার মৃত্যুবরণ করছেন, হামিদ স্যার শারিরীকভাবে খুবই অসুস্থ। নজরুল স্যার অবসরে, রওসনারা ম্যাডাম এখনো চাকরি করছেন।

লেখা: সোহেল রানা, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, কাঁকর কাটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, দৈনিক জনকণ্ঠ, পাবনা সদর।

আসিফ

×