ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা কবিতায় শীত

বাসার তাসাউফ

প্রকাশিত: ০১:৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৩

বাংলা কবিতায় শীত

আইয়ুব আল আমিন

কথায় আছে- ‘এক মাঘে শীত যায় না।’ এর বিপরীতেও আছে- ‘কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ।’ সময় এখন পৌষ মাস। পৌষ শীতের মাস। শীত মানেÑ কাঁথা-কম্বলের ওম্, খেজুরের রস, পাটালি গুড়, পিঠা-পায়েস, কোঁচায় ভরে মুড়ি খাওয়া, খড়-পাতায় আগুন জে¦লে জাড় তাড়ানোর প্রচেষ্টা এবং কাক-শালিক তাড়াতে ভোরে উঠে গমের ক্ষেতে ছুটে যাওয়া। শীতের প্রকোপে ঠা-া, হিম শীতল বাতাস ও কুয়াশাÑআস্তরণের জাল মাইলকে মাইল বিস্তৃত থাকে। কোথাও হালকা, কোথাও বরাবর বিছিয়ে রাখা লম্বা চাদর যেন বিছিয়ে রাখা।

কুয়াশার আস্তরণের সেই জাল ও চাদর ভেদ করে সূর্যের আলো আর উত্তাপ চরাচরে পৌঁছাতে পারে না ঠিকমতো। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে আবার উবে যায় আড়ালে। যেন সূর্যকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে বহতা জল। সেই জলের ক্ষুদ্ররূপ শিশিরকণা ঝরে পড়ে লাউ-কুমড়ো মাচায়, মাঠের দূর্বাঘাসের কচি ডগায়, লতাগুল্মে। আলপথ ধরে হাঁটতে গেলে শিশিরের পা ভেজে সব শরীর কাঁপে হি হি করে। মাটির চুলায় খড় কিংবা নাড়া পুড়িয়ে রান্না চড়ায় গ্রামের বধূরা। আগুনে চুলার চারপাশ আলোকিত হয়, আঁচ আসে।

সেই আঁচে উষ্ণ হওয়ার জন্য পিঁড়ি-মোড়া নিয়ে চুলার নিকটে বসে বাড়ির ছোটবড় সকলে। এটি শীতের পরিচিতি দৃশ্য। বিশেষ করে গ্রামে এমন হরহামেশা দেখা যায়। এ ছাড়া শীতকালে গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা, বাউল গান, পালা গান, সার্কাস এবং ওয়াজ-মাহফিলেরও আয়োজন হয়। 
মধ্য পৌষে শীত ঝেঁকে বসে প্রকৃতি যখন আপন রূপে সেজে ওঠে কবি সাহিত্যিকগণ তখন শীত নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে নিমগ্ন হন তাদের গল্প, কবিতা কিংবা গানে। শীত নিয়ে অনেক কবিতা ও গান রচিত হয়েছে। বিভিন্ন কবি শীতকে ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গে প্রকাশ করেছেন। মহাকবি কালিদাস (৩৭০-৪৫০) শীত নিয়ে ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে লিখেছেন, 
‘হে সুন্দরী! এবার শীতঋতুর কথা শ্রবণ করো
এই ঋতু শালিধান ও আমের প্রাচুর্যে মনোহর।’ 
শীতকাল নিয়ে কবি আলাওল (৯১৬০৭-১৬৮০) ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের ‘ষট-ঋতু বর্ণন’ খ-ে শীত ঋতু বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘সহজ দম্পতি মাঝে শীতের সোহাগে/হেমকান্তি দুই অঙ্গ এক হইয়া লাগে।’ 
এ চরণটিতে কবি দেহ মিলনের মধুর এক চিত্র বর্ণনা করেছেন। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্র্তী (আনু. ১৫৪০-১৬০০) লিখেছিলেন, 
‘উদয় পুরিয়া অন্ন দৈবে দিলা যদি।
যম-যম শীত তিথি নিরমিলা বিধি
...পৌষের প্রবল শীত সুখী যেজন।
তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ॥
ফুলরা কত আছে কর্মের বিপাক
মাঘ মাসে কাননে তুলি নাহি শাক॥’ 
আধুনিকালের কবিদের কবিতায়ও শীতের বর্ণনা আছে। এ ক্ষেত্রে কবি ঈশ^রচন্দ্র গুপ্ত’র (১৮১২-১৮৫৯) ‘কাব্য কানন’ গ্রন্থের ‘মানিনী নায়িকার মানভঙ’ কবিতায় খানিকটা কৌতুক ও হাস্যরসে বর্ণনা করেছেন, 
‘বসনে ঢাকিয়া দেহ গুঁড়ি মেরে আছি।
উহু উহু প্রাণ যায় শীত গেলে বাঁচি॥
হাসিয়া নাগর কহে, খোল প্রাণ মুখ।
শীত-ভীত হয়ে এত ভাব কেন দুখ॥
ছয় ঋতুর মধ্যে শীত করে তব হিত।
হিতকর দোষী হয় একি বিপরীত॥’ 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এক পরিপূর্ণ কবির নাম। তাঁর কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, এমনকি তাঁর চিঠিপত্রেও আমাদের জীবনের যাবতীয় বিষয় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সকল ঋতু নিয়েই তাঁর লেখা কবিতা ও গান আছে। শীত ঋতুও বাদ পড়েনি। তিনি লিখেছেন, ‘এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরই জয়।’ তিনি আরও লিখেছেন, 
‘শীত যদি মোরে দাও ডাক দাঁড়ায়ে দ্বারে।
সেই নিমিষেই যাবো নির্বাক অজনার পারে।’ 
এ ছাড়া তাঁর কবিতায় ও গানে শীতের নির্মমতাও প্রকাশ পেয়েছে।
 তিনি ‘কথা’ কাব্যের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘¯œান সমাপন করিয়া কূলে উঠে নারী সকলে
মহিষী কহিলা, ‘উহু শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জে¦লে দে আগুন ওলো সহচরী শীত নিবারিব অনলে।’ 
আমাদের জাতীয় কবির কবিতায়ও শীতের অনুষঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁর ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যে ‘পৌষ’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘পউষ এলো গো।
পউষ এলো অশ্রু পাথার হিম পারাবার পারায়ে।’ 
শীত নিয়ে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ কোনো কবিতা লিখবেন না তা কি হয়? তিনিও লিখেছেন অনুপম কিছু পঙ্ক্তি। তাঁর বিখ্যাত ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যে ‘শীতরাত’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’ 
তিনি ‘রাত্রি ও ভোর’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘শীতের রাতের এই সীমাহীন নিস্পন্দ গহ্বরে
জীবন কি বেঁচে আছে তবে! 
‘হেমন্তরাতে’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘শীতের ঘুমের থেকে এখন বিদায় নিয়ে বাহিরের অন্ধকার রাতে
 হেমন্তলক্ষ্মীর সব শেষ অনিকেত আবছায়া তারাদের
 সমাবেশ থেকে চোখ নামায়ে একটি পাখির ঘুম কাছে।’ 
এ ছাড়াও ‘নবপ্রস্থান’ কবিতায় তিনি শীতের বর্ণনা করেছেন, 
‘শীতের কুয়াশা মাঠে; অন্ধকারে এইখানে আমি।
আগত ও অনাগত দিন যেন নক্ষত্রবিশাল শূন্যতার।’ 
তিনি ‘একদিন কুয়াশার’ কবিতায় মর্মমূলের ভাব প্রকাশ করেছেন এভাবে, 
‘একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর; জানি;
 হৃদয়ের পথ-চলা শেষ হলে সেই দিনÑ গিয়েছে সে শান্ত হিম ঘরে।’ 
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) এর বহুল পঠিত ‘রাখাল ছেলে’ কবিতায় শীতের অনুষঙ্গ এভাবে ফুটে উঠেছে, 
‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির ঝরা ঘাসে
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’  
বাংলা কাব্যভুবনে অপার বিস্ময় জাগানিয়া কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর বিখ্যাত ‘ছাড়পত্র’ কাব্যে ‘প্রার্থী’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘হে সূর্য! শীতের সূর্য!
 হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ।’ 
কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) ‘উদ্ভট উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘শীতের দুপুরে নিউইয়র্কের অরচার্ড স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরে
একটি দোকান দেখি মায়াপুরী...।’ 
‘রুপালি ¯œান’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘দু’টুকরো রুটি
না পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক গাঁ ঘুমেই বিবর্ণ হই।’ 
কবি আল মাহমুদ ‘জানুয়ারি দু’হাজার’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘না শীত, না গরমে মজা ফেরি করে ভোরের বাতাস
ফেলে যাওয়া মাফলারে জানি লেগে আছে তোমার ছোঁয়া।’ 
আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০) লিখেছেন, 
‘শীতের ঢেউ নামি আসবে ফের
আমার বুড়ো হাড়ে ঝনাৎকার।’ 
কবি আসাদ চৌধুরি ‘সন্দেহ’ কবিতায় ছন্দে ছন্দে শীতের বন্দনা করেছেন এভাবে, 
‘চিরল চিরল পাতা বাতাস পাইলে কাঁপে
সাপের মতো লক লকাইয়া চুলার আগুন তাপে
আমার শীতে দেহ কাঁপে।’ 
এ ছাড়াও শীতের উল্লেখ পাওয়া যায় কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র (১৯৫৬-১৯৯১) ‘নষ্ট অন্ধকারে’ কবিতায়, 
‘আমিও সারারাত মৃত মানুষের শীতেÑ শীতার্দ্র হয়েছিলামÑ।’ 
কবি আবিদ আজাদ ‘শীত আমার কবিতার ঋতু’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘এই শীতেই আমার শ^াস কষ্টের কালো জল ঝলকাতে থাকে
মাছের আকাশের রৌদ্র জীবিত কবিতায়
শীত তাই আমার প্রিয় ঋতু
শীত তাই আমার কবিতার ঋতু।’ 
কবি কামাল চৌধুরী ‘পদচিহ্ন, কবিতায় লিখেছেন, 
‘হে পূর্ণিমা, হে শীত,
শীতের কুয়াশায় ভেজা কনকনে হিমেল বাতাস
তোমরা সাক্ষী থেকো।’ 
কবি আসাদ মান্নান ‘প্রত্যাবর্তন নিজের দিকে’ কবিতায় লিখেছেন, 
‘শীতের আকাশ যেন কুড়োতেছে নাক্ষত্রিক বরফের কুচি।’ 
এভাবে শীত নিয়ে কবিগণ নানাভাবে পঙ্ক্তি রচনা করেছেন। শীত ঋতুতে আমাদের পোশাক-আশাকে ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে। কিন্তু কেউ কেউ বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন হয়ে কষ্টে বেঁচে থাকে। সে বিষয়েও কবিতা রচিত হয়েছে। কিন্তু বস্ত্রহীনের সেগুলো পড়েও দেখে না। কারণ- তারা পড়তে জানে না। তারা শুধু জানে দুঃখ নিয়ে জীবন চললেও কাব্য চলে না।

×