ভাওয়াইয়া স্বরে বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু পাহাড় সমান/বাংটু বামন নোয়ায়
আগুন পানিত যাইবে ডুবি/জাবরা জাকন ধুমায়
‘ভাওয়াইয়া স্বরে বঙ্গবন্ধু’ এস এম আব্রাহাম লিংকনের একটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাওয়াইয়া ভাষায় রচিত একক কাব্যগ্রন্থও এটি। গ্রন্থটি ডিসেম্বর ২০২১ প্রথম প্রকাশিত হয় যুক্ত প্রকাশনী থেকে। গ্রন্থে মোট এগারোটি কবিতা যা উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা তথা ভাওয়াইয়ার স্বরে স্থান পেয়েছে।
কবিতাগুলোর মধ্যে কিছু অপরিচিত আঞ্চলিক শব্দ রয়েছে যার মর্ম বোঝাতে কবি প্রতিটি কবিতার শেষে পাদটীকা সন্নিবেশ করেছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রন্থটিকে সমাদৃত করতে কবিতাগুলোর ইংরেজী ভাষান্তর করেছেন আলিম আল রাজী সায়েম কুশল। যা গ্রন্থটির মূল্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কবি উৎসর্গে লিখেছেন- ‘শেখ হাসিনা ভাওয়াইয়া ভাষাভাষীদের পুত্রবধূ আপন কর্মে ভুবনজয়ী’। এই কাব্যগ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের কলা অনুষদের ডিন ও বাংলা বিভাগের প্রধান ড. তুহিন ওয়াদুদ।
ড. ওয়াদুদ লিখেছেন- কবিতাগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নানা পর্বের জীবনালেখ্য ভাওয়াইয়া কাব্যধারায় তুলে ধরেছেন। তিনি আরও লিখেছেন এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠকদের যেমন ভাললাগার বিষয় হবে তেমনি প্রতিটি কবিতার মধ্য দিয়ে পাঠক একটা ইতিহাসের পাঠ পাবেন।’ গ্রন্থটির চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি লিংকন একাধারে আইনজীবী, শিক্ষক, লেখক, গবেষক, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাহক ও রাজনীতিক হিসেবে সমধিক পরিচিত। তিনি বাগ্মীতার কারণেও জনপ্রিয়। তাঁর লেখনীর প্রধান উপজীব্য বিষয় উত্তরবঙ্গের নানা অনুষঙ্গ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহান মুক্তিযুদ্ধ, কবিতা ও সমসাময়িক নানা ঘটনাবলী।
বিশেষত উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তিনি শুধু এই নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ‘ভাওয়াইয়ার স্বরে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থটি রচনা সেই সৃষ্টিশীলতারই পরিচায়ক।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রমিত বাংলায় অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় তেমন কোন কাজ নজরে পড়ে না। বিশেষ করে ভাওয়াইয়ার ভাষায় কোন গ্রন্থ নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। সেদিক বিবেচনায় কবি লিংকন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু কবিতা রচনায় দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের শক্তিশালী মাধ্যম ভাওয়াইয়ার স্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম পরিচয় ও জীবন সংগ্রামের কথা, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান, ভাষা আন্দোলন, ফারুক-মোস্তাক-ডালিমের মতো বিশ্বাসঘাতকদের বিবরণ, যুদ্ধে বাঙালীদের করুণ চিত্র, ব্রিটিশদের অত্যাচার প্রভৃতি বিষয় অত্যন্ত চমৎকারভাবে বাণীবদ্ধ করেছেন।
পাঠক প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে একটা গতি ও দোল পাবেন। পাশাপাশি কাব্যপিপাসু পাঠক প্রতিটি কাব্যের রূপ, রস, স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন। কবি ভাওয়াইয়ার শক্ত গাঁথুনিতে বঙ্গবন্ধুকে ছন্দাকারে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, গ্রন্থটি রচনায় কবি সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে ফারুক-মোস্তাক-ডালিমের বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয়কে তিনি বিষধর সর্পের পরিচয়ে চিত্রিত করেন। কবি ‘খুন করছে বাপোক যাঁই/তাঁই ডারাইস সাপ’ কবিতায় ভাওয়াইয়ার সুরে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন- সাপো বাহে মানুষ সাজে/মাঝে মাঝে তাঁই/ফারুক ডালিম মোস্তাকের মতোন/নিমক হারাম যাঁই।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালী জাতি যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেই চিত্র ‘মুজিব নামটা তামার’ কবিতায় বর্ণনা করেছেন এভাবে- মুজিবরে নামটা তামার/শ্যাকের ব্যাটা শ্যাক/তার ডাকোতে হছলং বাহে/হামরাগুলা এক।
ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান তা অনস্বীকার্য। আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহাননেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ; পরবর্তী সময়ে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সংক্রিয় অংশগ্রহণ ও তাঁর অবদানের কথা কবি কবিতার ভাষায় তুলে ধরেছেন এভাবে- মিটিং মিছিলে ছাত্র চাষা/ দাবি কচ্ছিল বাংলা ভাষা/জীবন দিয়াও জয় আনিছে তাই। কবি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যাকে উত্তরবঙ্গে পাত্রস্থ করার বিষয়টিকেও সুন্দুরভাবে তুলে ধরেছেন ‘এক্কেবারে সত্যি’ কবিতায়। কবি লিখেছেন- এ কতা তো মিছা নোয়ায়/এক্কেবারে সত্যি/ শ্যাক মজিবর বেটিক দিছে/হামারগুলার এত্তি।
কবি লিংকন প্রতিটি কবিতায় তাল-লয়-ছন্দ-রসের চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রামের বিচিত্র সন্নিবেশ ঘটেছে তাঁর কাব্যে। এদিক বিবেচনায় কবি লিংকন প্রথম প্রচেষ্টায় সফল। সর্বোপরি গ্রন্থটি কাব্যপ্রেমী পাঠকদের যেমন তৃপ্ত করবে তেমনি কবিতায় ইতিহাস খুঁজতে গেলে এটি আঁকড়গ্রন্থ হিসেবে সহায়ক হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।