ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শাহাদাৎ সরকার

পদাতিকের কবি

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ২৯ জুন ২০১৮

পদাতিকের কবি

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার অভিনবত্ব পদে পদে চমক লাগিয়েছিল বাঙালী পাঠকদের। তাঁর এই অভিনবত্বের পেছনে ছিল সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসা। তাঁর প্রিয় শব্দাবলীর তালিকায় শীর্ষের শব্দটিও ছিল ভালবাসা। তা ছড়িয়ে পড়েছিল সামষ্টির মধ্যে। ফলে তাঁর কবিতা অগ্রজ কবিকুলের থেকে হয়েছিলেন স্বতন্ত্র। যদিও তাঁর কবিতায় ছিল সমাজবাদী বিদ্রোহ ও সাম্যবাদের সুর। সেই সাম্যবাদের সুরকে তাঁর পূর্বজ কবিদের মধ্যে ‘কল্লোল’ যুগের যে ব্যক্তি মুক্তির হাওয়া বয়ে চলছিল, তা কখনও প্রভাবিত করতে পারেনি। এমনকি তাঁর কাব্য চিন্তাকে কোনভাবেই টলাতে পারেনি। এই ব্যক্তিবাদী কবিদের পাশাপাশি ছিল ইউরোপিয় রোমান্টিকতা ও প্রকৃতিবাদ। আরও ছিল বিশাল বটবৃক্ষের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১Ñ১৯৪১) ও পাশাপাশি বিপুল বিস্ময়কর প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি ছিলেন ব্যক্তিবাদী কবিতার বিরোধী। তিনি একার জন্য মুক্তি কামনা করেননি। করেননি কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য, তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র মানুষের মুক্তি; আর তাই সমগ্র মানব সম্প্রদায়ের মুক্তির নিমিত্তেই করেছেন কবিতার চর্চা। ফলে তার সমস্ত কবিতায় মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে মানুষের প্রতি অফুরান ভালবাসা। মানবপ্রেমিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় জন্মছিলেন অবিভক্ত বাংলার কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ সালে। পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্রীমতী যামিনী দেবী। পিতার থেকে প্রাপ্ত ‘চন্দ্র’ অংশ যুক্ত করে সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামে প্রথম দিকে কবিতা লিখলেও; অল্প কিছু পরেই এই ‘চন্দ্র’ শব্দটি বর্জন করেন এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামে খ্যাত হন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’(১৯৪০) প্রকাশ করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামেই। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিরিশের ব্যক্তিবাদী কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮Ñ১৯৭৪) দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং একই বছরে বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তরুণতম কবি হিসেবে অভিনন্দন জানিয়ে এই বলেন- সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য : প্রথমত, তিনি বোধ হয় প্রথম বাঙালী কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি, প্রকৃতিÑবিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; কোন অস্পষ্ট, মধূর সৌরভ তাঁর রচনায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম কবিতাগুলোতে লক্ষণীয় ছিল। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসমান্য যে কাব্যরচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে ব’লে মনে করি। (বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় : ‘পদাতিক’, কালের পুতুল, প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০১৩, সুচয়নী পাবলিশার্স, পৃ. ৭৮) চল্লিশের দশকে ‘পদাতিক’ দিয়ে কাব্যচর্চা শুরু হলেও দীর্ঘ জীবন শেষে ৮ জুলাই ২০০৩ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের উপহার দিয়েছেন বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ছড়ানো ঘুটি’; প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এছাড়াও পর্যাক্রমে সৃজন করেছেন ‘অগ্নিকোণ’ (১৯৪৮), ‘চিরকুট’ (১৩৫৭), ‘যত দূরে যায়’ (১৩৬৯), ‘কাল মধুমাস’ (১৯৬৬), ‘এই ভাই’ (১৯৭১), ‘ছেলে গেছে বনে’ (১৯৭২), ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’(১৯৭৯), ‘জল সইতে’(১৯৮১), ‘চইচই চইচই’ (১৯৮৩), ‘বাঘ ডেকেছিল’ (১৯৮৫), ‘যা রে কাগজের নৌকা’(১৯৮৯), ‘ধর্মের কল’ (১৯৯১), ‘ফুল ফুটুক’ (১৩৯৯), ‘একবার বিদায় দে মা’ (১৯৯৫) নামীয় কাব্যগ্রন্থ। শুধু মৌলিক কবিতা সৃজনই নয় পাশাপাশি অনুবাদও করেছেন নাজিম হিকমাত, পাবলো নেরুদা, নিকোলো তাপ্ৎসারভ ও হাফিজের কবিতার। তাই বলে শুধুমাত্র কাব্যচর্চার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর সৃজন প্রক্রিয়া বহুধারায় বিচ্ছুরিত হয়েছে। সৃজন করেছেন ভ্রমণসাহিত্য, উপন্যাস ও প্রবন্ধ; দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সম্পাদনাতেও। তার সম্পদনা কর্মের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো কবি ‘প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছাত্র অবস্থা থেকেই জড়িত ছিলেন কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে। আর রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত থাকাকালে সভা-সমিতি, মিছিল করার মাঝে মাঝে কবিতা লিখতেন। সে প্রসঙ্গে জানতে পারি তাঁর কবি বন্ধু অরুণমিত্রের ‘সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে’ মনোহর প্রবন্ধে। শোনা যাক সে কথা- ছাত্র অবস্থাতেই সুভাষ সক্রিয় রাজনীতি করত। আলাপের পড়ে (পরে) দেখলাম, ছেলেটির কবিতার চেয়েও রাজনীতিতে মন বেশি। তবে, রাজনীতি করতে করতে সভা, সমিতি, মিছিল, রণক্ষেত্রেই দিব্যি কবিতা লিখে ফেলতে পারে। (অরুণ মিত্র, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্য, সন্দ্বীপ দত্ত সম্পাদিত, প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০১২, র‌্যাডিকাল পাবলিশার্স, পৃ. ৫৭) তাঁর কবিতার বিরাট অংশ জুড়ে রাজনীতির প্রসঙ্গ থাকলেও; তিনি কবিতা চর্চা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করে। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি থেকে রবীন্দ্রনাথ পাঠ ছিল নিষিদ্ধ। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুসরণ করে কবিতা চর্চা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই সচেতনভাবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন নিজস্ব কাব্যভাষা (চড়বঃরপ উরপঃরড়হ)। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলছেন- আমরা যখন লিখতে শিখেছি সেটা ওই রবীন্দ্রনাথকে ধরে। যাই লিখি, লোকে বলে, ‘বাঃ, ভাল, ঠিক রবি ঠাকুরের মত’। গোড়ায় এসব কথা শুনে খুশি হতাম, কিন্তু পরে বুঝলাম যে, যদি আমার লেখা রবীন্দ্রনাথের মতনই হয় তাহলে আমার কী দরকার, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই যখন রয়েছেন। কপিটাকে লোকে নেবে না, মূলটাকেই নেবে। তখন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সরে আসার চেষ্টা শুরু করলাম। এটা খুব সহজ হয়নি, তবে নিশ্চয় হয়েছিল; কারণ, একটা সময় লোকে আর রবীন্দ্রনাথের মত হয়েছে বলত না। (পদাতিক : সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাতকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্য, সন্দ্বীপ দত্ত সম্পাদিত, প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০১২, র‌্যাডিকাল পাবলিশার্স, পৃ. ৪০) এই যে নিজেকে স্বাতন্ত্রিক করে তোলার চেষ্টা শুরু করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তার সফল রূপ দেখি ‘পদাতিক’ কাব্যের কবিতার মধ্যেই। তিনি ভাষাগত দিক থেকেই নয়; বিষয়গত দিক থেকেও হয়ে ওঠেন আলাদা ও অনন্য। একটি নির্দিষ্ট আদর্শ নিয়ে কবিতা সৃজন শুরু করলেন। তবে সেই আদর্শ সুভাষের কাছে হয়ে থাকলো তত্ত্বগত। বাস্তবজীবনে তার পরিচয় পেলেন না। যেহেতু তিনি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গিয়েছিলেন একেবারে মাটি সংলগ্ন মানুষের কাছে। আর সেই কারণে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের। কেননা, একটা পর্যায়ে এসে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে দেখি তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনীতি শুরু করলেও সাধারণ মানুষের কথা তিনি ভুলে জাননি। ফলে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সকল মানুষের উন্নয়নকে পৃথিবীর উন্নয়ন বলে মনে করলেন। আর তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিকে’ ঘোষণা করছিলেন- ‘আমাদের থাক মিলিত অগ্রগতি একাকী চলতে চাই না এরোপ্লেনে, আপাতত চোখ থাক পৃথিবীর প্রতি, শেষে নেয়া যাবে শেষকার পথ জেনে।।’ (সকলের গান, পদাতিক) এই সকলের জন্য ছিলো তাঁর হৃদয় ভরা দরদ। তাই তো চীন জাপান যুদ্ধ শুরু হলে তিনি লিখলেন- ‘জাপপুষ্পক ঝরে ফুলঝুরি, জ্বলে হ্যাঙ্কাও কমরেড, আজ বজ্রে কঠিন বন্ধুতা চাও লাল নিশানের নিচে উল্লাসী মুক্তির ডাক রাইফেল আজ শত্রুপাতের সম্মান পাক।’ (চীন : ১৯৩৮, পদাতিক) যদিও কবিতাটিতে সরাসরি ‘লাল নিশান’ দ্বারা রাশিয়ার বিপ্লবীদের বোঝানো হচ্ছে কিন্তু তবুও যারা মানব বিধ্বংসী তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আহ্বান জানাচ্ছেন কবি। এমনকি যদি স্বয়ং রাশিয়ার বিপ্লবীরাও মানবতার শত্রু হয় তাহলে কবি যে তাদের পক্ষে থাকবেন না; তাঁর প্রমাণ হিসেবে আমরা কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগদানকে উল্লেখ করতেই পারি। আর তাঁর এই মানবপ্রেমি মনোভাব শুধু আন্তর্জাতিকতার মধ্যেই থাকেনি; তা বিস্তার লাভ করেছে দেশের অভ্যন্তরের নিঃস্ব অসহায় সাধারণ মানুষগুলো প্রতি। তিনি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সাধারণ মানুষগুলোর বঞ্চনার যে দৃশ্য দেখেছিলেন তাও তাঁর মানসপটে ছাপ ফেলে। এদেশের সাধারণ কৃষকের প্রতি জমিদার শ্রেণীর যে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও নিষ্পেষণ তার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি দেখলেন সাধারণ কৃষকদের সংসারে নেই কোন অর্থÑ সম্পদ, ঘরে নেই খাবার। না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষকে। তবুও জমিদারদের দিতে হচ্ছে খাজনা। জমিদার শ্রেণীর এই অন্যায়ের প্রতিবাদে বলে উঠলেন- ‘পেট জ্বলছে, ক্ষেত জ্বলছে হুজুর, জেনে রাখুন খাজনা এবার মাপ না হলে জ্বলে উঠবে আগুন।’ (চিরকুট, চিরকুট) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় যেমন আছে সাধারণ মানুষের কথা। তাদের বঞ্চনার কথা, আছে দাবি আদায়ের কথা। পাশাপাশি আছে প্রেমের কথাও। এই বিষয়ে কবির বন্ধু রমাকৃষ্ণ মৈত্র বলছেন- গীতার সঙ্গে বিবাহ এবং ১৯৫২-৫৩ সালে বজবজে বছর দুয়েকের নরনারীর জীবযাপনের মধ্য দিয়ে জীবনবোধের অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে তার কাব্যদেহে এই বৃত্তিগুলো ও সমুচিত মর্যাদা পেতে শুরু করেছিল। তাও, সেগুলোর মধ্যে আকুতি, আর্তি, হিন্দোল থাকলেও উষ্ণ রক্তের টগ্বগে ভাবে তেমন নেই। তাই ‘মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ’ থেকে শুরু তা যখন ‘উত্তোলিত বাহুর তরঙ্গে তোমাকে ঢেকে দিল/যখন তোমাকে আর দেখা গেল না-/ তখনই/ আশ্চর্য সুন্দর দেখাল তোমাকে/-’র মধ্যে দিয়ে ‘তুমি আলো, আমি আধারে আলো বেয়ে/আনতে চলেছি/লাল টুক্টুকে দিন’- বড়োজোর ‘মুখখানি যেন ভোরের শেফালি’ এবং ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ পর্যন্ত পৌঁছে প্রায় শেষ হয়ে গেল। (রমাকৃষ্ণ মৈত্র, দিগি¦জয়ী পদাতিক, সুভাষ মুখোপাধ্যায় : কথা ও কবিতা, শঙ্খ ঘোষ ও অন্যান্য সম্পাদিত, পুনর্মুদ্রণ : শ্রাবণ ১৪২১, দে’জ পাবলিশিং, পৃ. ৫২-৫৩) এই হলো রাজনৈতিক সুভাষের কবিতায় প্রেমের চিত্র। জৈবিক প্রেম বা নারী প্রেম কখনোই তাঁর কবিতায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় ছিল। ফলে দেখি ১৯৫১ সালে দীর্ঘ দু’বছরের কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে কবি স্বস্ত্রীক যান বজবজ। সেখানে তার প্রতিবেশি ছিল সলেমন নামের একটি মেয়ে ও তার মা। এই সলেমনের মায়ের পাগলী স্বামীকে ছেড়ে এসে বাবার বাড়িতে যে অসহনীয় জীবনযাপন সে চিত্র আকলেন ‘সলমনের মা’ কবিতায়। তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলামিত্রকে নিয়ে লিখলেন ‘পারুল বোন’। ১৯৬৪ সালে ‘যত দূরে যাই’ কাব্যের জন্য আকাদেমী পুরস্কারে ভূষিত হন। এই পুরস্কার কবি গ্রহণ করলে পার্টি থেকে নানা কথা বলা হলে তিনি লেখেন ‘কাছের লোক’ কবিতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে করেছিল আলোড়িত। ফলতঃ তাঁর কবিতা পাঠে আমরা পায় সেই প্রসঙ্গ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতার বিষয়গত দিকে থেকে যেমন স্বতন্ত্র ছিলো, তেমনি আঙ্গিকগত দিক থেকেও ছিল ভিন্নতা। তিনি মাত্রাগুণে কবিতা লেখার পক্ষে ছিলেন না। কবিতা লিখতেন তানের উপর নির্ভর করে। বাংলা পয়ার ছন্দে তিনি আনেন নতুনত্ব। তাঁর এই ছন্দ দক্ষতা আকৃষ্ট করেছিল ত্রিরিশের ছন্দ অভিজ্ঞ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। এই যে ছন্দের নতুনত্ব; তার পরিচয় মেলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থে। ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছন্দের যে নতুনত্ব দেখানোর প্রচেষ্টা করলেন; তা তাঁর অগ্রজ কবি ও সমালোচকদের কাছে প্রসংশিত হয়েছিল। তাঁর সৃজিত কিছু কবিতা থেকে দেখি সেই নতুন আঙ্গিক তৈরি দৃষ্টান্ত। ধরা যাক ‘এখানে’ কবিতার কয়েকটি পঙ্তি : ‘সেই নাগরিক ধূসর জীবন পেছনে ফেলে সব থেকে দ্রুত ট্রেনে ক’রে আজ এখানে আসা। আসানসোলে।’ মাত্রাবৃত্ত ছত্তে সৃজিত কবিতা এটি। প্রথম পঙ্তির প্রতিটি পর্বে মাত্রা সংখ্যা ৬+৬। তৃতীয় পঙ্তিতেও একই রকম। আবার দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পঙ্তির মাত্রাও ৫এবং দ্বিতীয় পঙ্তির সাথে পঞ্চম পঙ্তির অন্তমিল দেওয়া হয়েছে। আবার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এনেছেন অভিনবত্ব। ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বধূ’ কবিতা তাঁর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দেখা যাক ‘বধূ’ কবিতার দুটি পঙ্তি : ‘সারা দুপুর দিঘির কালো জলে গভীর বন দুধারে ফেলে ছায়া,’ এই পঙ্তি দুটির প্রত্যেক পর্বের মাত্রা সংখ্যা পাঁচ। অবশ্য অনেক সমালোচক মনে করেন এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃজিত ‘বধূ’ কবিতাকে কাউন্টার করে লেখা। দুটি কবিতাই পাশাপাশি রেখে পড়লে পাঠক হয়তো তাঁর প্রমাণ পেতেও পারেন। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য শোনা যাক : এ-কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’কে ব্যঙ্গ করা হয়নি, তাকে বিশ-শতকী জীবন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। বিষয় এক, নামও এক, রবীন্দ্রনাথের কোনো-কোনো বাক্যাংশও ব্যবহৃত হয়েছে, তবুÑকিংবা সেই জন্যইÑএটি সত্যিকার মৌলিক রচনা হ’তে পেরেছে। (বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় : ‘পদাতিক’, কালের পুতুল, প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০১৩, সুচয়নী পাবলিশার্স, পৃ. ৮৭) আগেই বলেছি তাঁর কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রাজনীতি। আর রাজনীতি প্রসঙ্গ আসার কারণে অনেক সময় সুভাষের বেশ কিছু কবিতা দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়েছে। সেই আক্রান্তটা খুব বেশি স্থায়ী হয়নি। এই বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু শেষাবধি তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে ছিলেন এই বলে- যখন এবং যতক্ষণ তিনি কবি, কবিতার উৎকর্ষই হবে তাঁর সাধনা। হয় তাঁকে কর্মী হ’তে হবে, নয়তো কবি। তিনি কোন দিক ছাড়বেন? (বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় : ‘পদাতিক’, কালের পুতুল, প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০১৩, সুচয়নী পাবলিশার্স, পৃ. ৮৮) কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত কোন দিকই ছাড়েননি। তিনি একসঙ্গে কবি ও কর্মী দুই ছিলেন। সুভাষের কবিতা স্মরণীয় করে রাখবে তাঁকে; কারণ তিনি তৈরি করেছিলেন কবিতার আলাদা জগত। যা তার সমকালীন অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। চল্লিশের একক কবি বলতে এখন অবধি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নির্ধারণ করেছেন সমালোচকরা। ইমেল : সংযড়ংংধহ.ৎঁ১২@মসধরষ.পড়স ০১৭৬৭ ০৬৩৩৮৩।
×