জীবন সঙ্গী নির্বাচনে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত ‘বউ মেলা’
জীবন সঙ্গী নির্বাচনে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত ‘বউ মেলা’ দিনাজপুরের গোলাপগঞ্জের এক ঐতিহ্যিক মিলন সৌধ। কিংবদন্তি আছে, প্রায় দুইশ’ বছর ধরে উদ্যাপনের মতো এই ঐতিহাসিক কর্মযোগ আজও তার মর্যাদায় টিকে আছে। একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির নব আঙিনায় পুরাকালীন বহু সংস্কারের আবেদন যুগ-যুগান্তরের মিলন দ্যোতনা। আসলেই জীবন সঙ্গী বাছাই সংসার আর পারিবারিক আবহের পরম নির্মাল্য। সারাজীবন ধরে যার সঙ্গে কাটাতে হবে তাকে যদি নিজের মতো করে পাওয়া না যায় তাহলে নিত্য কলহ, বিবাদ এক আবশ্যকীয় দুর্ভোগ।
আধুনিক যুগ পরিক্রমায় নিজের পছন্দের সঙ্গী নির্বাচনে সবাই সচেতন-উদ্বিগ্নতায় আগামীর জীবনকে নিয়ে ভাবতে বসাও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। বিশেষ করে সমসংখ্যক নারীর ক্ষেত্রে তো অনেকখানিই। আমাদের সমাজ সংস্কারাচ্ছন্ন এক প্রতিবেশের নিয়মবিধির বেড়াজাল। সেখানে নারী নিগ্রহও চলে আসা দীর্ঘ প্রক্রিয়া আর এক দুর্ভেদ্য বলয়। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে বহুবার নারী স্বাধীনতা, অধিকার সমসংখ্যকের জন্য অবাধ আর অবারিত না হলে সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে নিয়ন্ত্রণ কঠিন। যে কোনো মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীনই শুধু নয় নিরপেক্ষও বটে।
সেখানে আজন্ম মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে সব কার্যক্রমে স্বাধীন সত্তাও নিতান্ত জরুরি। সমাজের মৌলিক অধিকারগুলো নারী-পুরুষ প্রত্যেকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তবুও কোথায় যেন ফাঁকফোকর থেকেই যায়। বিয়েতে সম্মতি দেওয়ার অধিকারই শুধু নয় জীবন সঙ্গী বাছাই তার আজন্ম লালিত বোধও অনিবার্য বিধি। সেখানে উৎসব-আয়োজনে মেলা বসিয়ে জীবনের গভীরতম বলয়ে প্রবেশের প্রাক্কালে যদি পছন্দসই মানুষের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা যায় সেটাও কম পাওয়া নয়। এমনই একটি উৎসব মুখরিত মেলা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে সাড়ম্বরে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে।
গত দুই শতক ধরে প্রতিবছরই এমন বরণমেলা সংশ্লিষ্টদের মাতিয়েও দেয়। গণমাধ্যমের সংবাদ হয়ে সব জায়গায় জানানও দিয়ে যাচ্ছে। এখানে উদীয়মান অবিবাহিত পাত্র-পাত্রীরা সমবেত হয়ে আনন্দ-জৌলুসে সময় কাটান দিনভর। কোনো এক সময়ে পছন্দের মানুষের হাত ধরে তা বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত গড়ায়। অবিশ^াস্য এক মিলন দ্যোতনা যা দুই বিপরীত মানুষকে এক সুতায় বেঁধে দিতে নিয়ামকের কাজ করে। গোলাপগঞ্জই শুধু নয় ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারীর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন মানুষের সমাগমে মেলার সার্বিক আঙিনায় আনন্দের ঢেউ নামে। মূলত শারদীয় দুর্গোৎসবের দশমীর পর দিনই এমন মেলা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আর এক আলোড়ন তৈরি করে।
প্রচার, প্রচারণা ছাড়াই এমন অভাবনীয় মেলায় যোগ দেন গ্রামের বউ, শাশুড়ি, ননদ, জা, ঝিদের মিলন শোভায় চমৎকার পরিস্থিতি কানায় কানায় পূর্ণ থেকে পরিপূর্ণ হয়। উৎসব মুখরিত এই নান্দনিক বৌ মেলায় উৎসুক যুবকরা তাদের পছন্দ করা নারীকে জীবন সঙ্গিনীর মর্যাদা দিতে এগিয়ে আসে। শুরু হয় আর এক অভাবনীয় চমৎকৃত দৃশ্য। সঙ্গী বাছাই পর্বটাই আনন্দমুখর, দৃষ্টিনন্দন আর জীবনের পরম শুভক্ষণ তো বটেই। বাছাইপর্ব সম্পন্ন হলে পারিবারিকভাবে দু’পক্ষই বিয়ে নামক পবিত্রতম ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিতে বৈধতা দেওয়াও নীতি-নৈতিকতার অনুষঙ্গ।
সঙ্গী বাছাইয়ের এমন মহতি অনুষ্ঠানে সারি সারি শৃঙ্খলাবদ্ধ দোকানে যা থাকে তা আরও নয়নাভিরাম আর পরিবেশের অত্যাবশ্যক পর্যায়। নারী-পুরুষের জমকালো ঝলমলে উপস্থিতিই শুধু নয় বাহারি প্রসাধনী সামগ্রীর যে নান্দনিক পরিবেশনা তাও আর এক অভিনব চিত্র। ফিতা, কাচের চুড়ি, লিপস্টিক, কানের দুল, ঝিনুক ও মাটির গহনা ছাড়াও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত হরেক তৈজসপত্রও মেলায় সারিতে সাজানো-গোছানো থাকে। সেখানে ছুরি, কাঁচি, দা, বঁটি, কুড়াল এমনসব পরিবারঘনিষ্ঠ জিনিসপত্রও পুরো অনুষ্ঠানকে তার যথার্থ মর্যাদায় দাঁড় করিয়ে দেয়। বিভিন্ন দোকানের বিক্রেতারাও উন্মুখ হয়ে থাকে গ্রামের বউ, ঝিদের কাছে দ্রব্যসামগ্রী তুলে দিতে।
যেখানে তাদের ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে আসা এমন মুখরিত সঙ্গী বাছাই উৎসব পর্বটি আজও অঞ্চলবাসী আবেগ আর পরমানন্দে উপভোগ করছেন। পাশাপাশি জীবন সঙ্গী নির্বাচনকেও সবার আগে আমলে নিচ্ছেন। চারপাশের সমবেত জনগোষ্ঠী উল্লসিতভাবে জানান, মূলত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীই এমন আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করছে যুগ থেকে যুগান্তরে। যা আধুনিক সময়কেও নতুন মাত্রা দিচ্ছে।