
ছবি: প্রতীকী
ধোঁয়া-মুক্ত রান্নাঘর আমাদের ফুসফুসের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিনের জীবনে আমরা যে খাবার রান্না করি, তার জন্য জ্বালানি ব্যবহার করতেই হয়। কিন্তু অনেক সময় এই রান্নার সময় প্রচুর ধোঁয়া তৈরি হয়, বিশেষ করে কাঠ, খড়কুটো, গাছের ডাল বা কেরোসিনের মতো জ্বালানি ব্যবহার করলে। এই ধোঁয়ায় থাকা ক্ষতিকারক কণাগুলো খুব সহজেই আমাদের শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসের ভেতর জমে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এই ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকলে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসের সংক্রমণ এমনকি ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। ধোঁয়ার কণাগুলো এত ক্ষুদ্র যে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, কিন্তু শ্বাসের সঙ্গে তা অনায়াসেই দেহে প্রবেশ করে রক্তে মিশে যায় এবং অক্সিজেন পরিবহন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
গ্রামীণ ও শহুরে অনেক রান্নাঘরে এখনো সঠিক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা নেই। ছোট, বন্ধ ঘরে রান্না করলে ধোঁয়া বাইরে বের হতে পারে না এবং ঘরের ভেতর জমে যায়। ফলে রান্না করা মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে সেই ধোঁয়ার মধ্যে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়। এভাবে প্রতিদিনের রান্না ধীরে ধীরে শরীরে বিষক্রিয়ার মতো প্রভাব ফেলে। শুধু রান্না করা মানুষই নয়, আশপাশে থাকা শিশু, বয়স্ক বা পরিবারের অন্য সদস্যরাও এই ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয়। শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের পথ তুলনামূলকভাবে সরু এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় ধোঁয়ার ক্ষতি আরও দ্রুত ঘটে।
ধোঁয়ার মধ্যে থাকে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস। এগুলো ফুসফুসের ভেতরের নরম টিস্যুকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে কার্বন মনোক্সাইড শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদপিণ্ড এবং মস্তিষ্কের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রান্নার ধোঁয়া অনেক সময় চোখ জ্বালা, মাথাব্যথা এবং গলা ব্যথার মতো তাত্ক্ষণিক সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু এর চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো দীর্ঘমেয়াদে জমে থাকা ক্ষতি, যা প্রথমে বোঝা না গেলেও পরে গুরুতর রোগে রূপ নেয়।
ফুসফুস সুস্থ রাখতে হলে রান্নাঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। জানালা, ভেন্টিলেটর বা চিমনির মাধ্যমে ধোঁয়া দ্রুত বাইরে বের হয়ে যেতে পারলে তার ক্ষতি অনেকটাই কমে যায়। বর্তমানে অনেক জায়গায় গ্যাসের চুলা বা বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহারের প্রচলন বাড়ছে, যা ধোঁয়া তৈরি করে না বা খুব অল্প করে। তবে গ্রামীণ এলাকায় এখনো বহু মানুষ ঐতিহ্যবাহী চুলায় কাঠ বা খড় জ্বালিয়ে রান্না করেন, যা ধোঁয়ার অন্যতম প্রধান উৎস। এই ক্ষেত্রে উন্নত চুলা বা ‘ইমপ্রুভড কুকস্টোভ’ ব্যবহার করলে ধোঁয়া অনেকটা কমানো সম্ভব।
ধোঁয়া-মুক্ত রান্নাঘর কেবল শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে না, মানসিক স্বাস্থ্যেরও উপকার করে। ধোঁয়ার কারণে রান্না করা মানুষ ক্লান্তি, মাথা ঘোরা বা শ্বাসকষ্টে ভোগেন, যা তাদের কাজের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ধোঁয়া-মুক্ত পরিবেশে রান্না করলে স্বস্তি বজায় থাকে, শ্বাস নেওয়া সহজ হয় এবং রান্নার সময় মানসিক চাপও কম থাকে। পাশাপাশি ঘরের আসবাব, দেয়াল বা কাপড়ে ধোঁয়ার কালো দাগ জমে না, ফলে বাসার পরিবেশও পরিষ্কার থাকে।
সুস্থ জীবনযাপনের জন্য আমাদের ফুসফুসকে সুরক্ষা দেওয়া অপরিহার্য। প্রতিদিন আমরা অক্সিজেন গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে থাকি, আর ফুসফুসই সেই অক্সিজেন আমাদের শরীরে সরবরাহ করে। যদি ধোঁয়ার কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই তার প্রভাব অনুভব করে। তাই রান্নাঘরে ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ শুধু একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি পরিবারের সবার জন্য একটি জীবনরক্ষাকারী অভ্যাস। সচেতনতা ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই পারে ধোঁয়া-মুক্ত রান্নাঘর নিশ্চিত করতে এবং আমাদের ফুসফুসকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে।
এম.কে.