ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

চাকরির বাজারে ‘নিজেকে বিক্রি’ করতে না পারা মানেই আপনি খারাপ নন

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ৭ জুলাই ২০২৫

চাকরির বাজারে ‘নিজেকে বিক্রি’ করতে না পারা মানেই আপনি খারাপ নন

ছ‌বি: প্রতীকী

আজকের যুগে চাকরির বাজার অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক এবং কঠিন। ভালো চাকরি পাওয়া মানেই শুধু যোগ্যতা বা দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না, বরং নিজের উপস্থিতি, ব্যক্তিত্ব, যোগাযোগ দক্ষতা এবং নিজেকে প্রেজেন্ট করার ক্ষমতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে অনেকেই যখন চাকরির জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন নিজের আত্মবিশ্বাস কমে যায় কিংবা মনে হয় তারা অন্যদের তুলনায় কম সক্ষম। অনেক সময় আমরা শুনি বা শুনিয়েই থাকি যে, যদি আপনি নিজেকে ভালভাবে ‘বিক্রি’ করতে না পারেন, তাহলে আপনি পেছিয়ে পড়বেন, কিংবা আপনি খারাপ বা অযোগ্য। কিন্তু এই ধারণা একদম সঠিক নয়। চাকরির বাজারে নিজেকে বিক্রি করতে না পারা মানেই আপনি খারাপ নন।

প্রথমেই বুঝতে হবে, ‘নিজেকে বিক্রি করা’ কথাটির অর্থ কী। এখানে ‘বিক্রি’ শব্দটি মূলত নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে উপস্থাপন করার বিষয় বোঝায়, যাতে নিয়োগকর্তা বা প্রতিষ্ঠান আপনাকে চাকরির জন্য উপযুক্ত মনে করে। তবে এটি কখনোই নিজের প্রকৃত মূল্য বা গুণাবলীকে কমিয়ে আনার মানে নয়। অনেক সময় আমরা নিজেদের নিয়ে এতটাই কঠোর হয়ে পড়ি যে, নিজের ভাল দিকগুলো উপস্থাপন করতে সংকোচ বা দ্বিধা বোধ করি। আবার অনেকে এমন কৃত্রিম বা ভানচালনা করে নিজেদের অতিরিক্ত বড় দেখানোর চেষ্টা করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্য ক্ষতিকর হয়।

চাকরির বাজারে নিজেকে বিক্রি করতে না পারার অর্থ এই নয় যে আপনি অযোগ্য, পারদর্শী নন বা কম যোগ্য। বরং এর পেছনে অনেক ধরনের কারণ থাকতে পারে, যেমন— আপনার যোগাযোগ দক্ষতার অভাব, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, সঠিক নির্দেশনা বা প্রশিক্ষণের অভাব, অথবা এমনকি মানসিক চাপ এবং আতঙ্ক। এই কারণগুলো অনেক সময় মানুষকে নিজের ক্ষমতা এবং দক্ষতা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে বাধা দেয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আপনার কোন গুণ নেই বা আপনি খারাপ।

অনেক প্রতিভাবান মানুষ প্রকৃতপক্ষে তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা নিয়ে নিজেরাই অসংলগ্ন বা অনিশ্চিত বোধ করেন। তারা হয়তো সঠিকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করার উপায় জানেন না বা তাদের দক্ষতা অন্যদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাননি। এটি এক ধরনের সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক বাধা। সেই সঙ্গে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বা কর্মসংস্থান ব্যবস্থা প্রায়শই শুধুমাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বা কাগজে সিলমোহর পাওয়ার দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন, কীভাবে যোগাযোগ করবেন, তা শেখানোর সুযোগ দেয় না।

অন্যদিকে, কিছু ক্ষেত্রে চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে মানুষের দক্ষতার সামঞ্জস্য থাকে না। অনেক দক্ষ এবং যোগ্য লোকের চাকরি না পাওয়ার পেছনে এই কারণও থাকে যে, তারা হয়তো নিজেদের পেশাগত ব্র্যান্ডিং বা নিজেকে বিক্রয়ের কৌশল জানেন না। এটি অবশ্যই দুঃখজনক, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তারা খারাপ বা অযোগ্য। বরং তাদের কেবল কিছু দিক থেকে আরো উন্নতি করতে হবে।

নিজেকে বিক্রি করতে না পারা মানে আত্মসম্মানের অভাব বা কম মানের হওয়া নয়। বরং এটি একটি শিখন প্রক্রিয়া। যারা এই দক্ষতাটি অর্জন করেন, তারা সময়ের সঙ্গে অনেক উন্নতি করে। প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব গতিতে শিখে এবং নিজেদের শক্তি খুঁজে পায়। চাকরির বাজারে ‘নিজেকে বিক্রি’ করার ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হলেও এটি সম্পূর্ণ মানুষের যোগ্যতা বা মূল্য নির্ধারণ করে না।

আমাদের অনেক সময় মনে হয়, যদি আমরা নিজেকে যথেষ্ট ভালভাবে উপস্থাপন করতে না পারি, তাহলে আমরা জীবনে পিছিয়ে পড়ব বা সফল হতে পারব না। কিন্তু বাস্তবতা হল, আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, সত্যনিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষের যেকোনো অভাব পূরণ করা সম্ভব। অনেক সফল ব্যক্তিত্বের জীবনী দেখলে দেখা যাবে, তারা কখনো নিজেকে অতিরিক্ত বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেননি, বরং নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন, ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছেন এবং তাদের যোগ্যতার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

তাছাড়া, চাকরির বাজার অনেক বড় এবং বৈচিত্র্যময়। অনেক ক্ষেত্রেই ‘নিজেকে বিক্রি’ করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনার দক্ষতা, কর্মদক্ষতা এবং প্রকৃত কর্মক্ষমতা। একটি সঠিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেলে, সেখানে নিজের কাজের মাধ্যমে নিজের মূল্য প্রমাণ করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মূল্য আরও বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদের নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হন।

সুতরাং, যারা এখনো নিজেকে প্রকাশ করতে বা বিক্রি করতে কিছুটা কম সক্ষম বোধ করছেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় কথা হল হতাশ না হওয়া। নিজেকে নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করা, নিজের ভালো দিকগুলোকে মূল্য দেওয়া এবং ধৈর্য ধরে নিজের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানো জরুরি। প্রয়োজন হলে যোগাযোগ দক্ষতা, প্রেজেন্টেশন বা সাক্ষাৎকারের কৌশল শেখার জন্য কোর্স করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ও অর্জনগুলোকে সঠিকভাবে সাজিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে।

সবশেষে বলতে চাই, চাকরির বাজারে নিজেকে বিক্রি করতে না পারা মানেই আপনি খারাপ নন। এটি শুধু একটি দক্ষতা যা শেখা এবং উন্নত করা যায়। প্রত্যেক মানুষই তার নিজের অনন্য গুণাবলী নিয়ে বিশ্বে এসেছে, এবং সফলতা পেতে হলে কেবল সেই গুণাবলীকে খুঁজে বের করে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। নিজেকে সঠিক মূল্যায়ন করুন, ধৈর্য ধরুন এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। সফলতা একদিন অবশ্যই আপনার দরজায় কড়া নাড়বে।

এম.কে.

×