
প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়ালেখা নিয়ে উদ্বেগ বা অ্যাকাডেমিক অ্যাংজাইটি এক নীরব বাস্তবতা হয়ে উঠছে। পড়াশোনার ভার, পরীক্ষার চাপ, অন্যদের প্রত্যাশা সবকিছু মিলে শিক্ষার্থীরা ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ প্রচণ্ড পরিশ্রম করেও নিজেদের পিছিয়ে মনে করছে, আবার কেউ নিয়মিত ভালো ফলাফল করেও মানসিক চাপে ভুগছে।
এই চাপ থেকে জন্ম নিচ্ছে ঘুমের সমস্যা, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি, অবসাদ এমনকি বার্নআউটের মতো মানসিক সংকট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব লক্ষণ অনেক সময় অভিভাবক, শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী নিজেরাও গুরুত্ব দিয়ে ধরতে পারেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা আরও গভীর হয়, যদি না তা লক্ষ্য করে আগেভাগে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
এই উদ্বেগকে দূরে সরাতে প্রয়োজন একটি সচেতন পরিবেশ যেখানে স্কুল, পরিবার ও শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে চাপকে স্বাভাবিক ধরে না নিয়ে, তা মোকাবিলার পথ খোঁজে। কিছু সহজ এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মানসিক ভার কমিয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে।
কী কী করতে পারেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা:
১. প্রত্যাশা হোক ভারসাম্যপূর্ণ
পরিশ্রম প্রত্যাশা করা যায়, কিন্তু সবসময় নিখুঁত হওয়া নয়। শিক্ষার্থীর আন্তরিক চেষ্টা ও ধীরে ধীরে উন্নতির স্বীকৃতি দিলে তারা ব্যর্থতার ভয় কাটিয়ে আরও মনোযোগী হয়। ভুল করলেও সম্মান হারানোর ভয় না থাকলে, তারা খোলামেলা চেষ্টা করতে পারে।
২. অস্বাস্থ্যকর তুলনা বন্ধ করুন
ভাইবোন, সহপাঠী কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে শিক্ষার্থীর তুলনা করা উচিত নয়। প্রত্যেকের শেখার ধরন আলাদা। এমন তুলনা শিক্ষার্থীদের মনে করে দেয় তারা সবসময় পিছিয়ে। এতে আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে।
৩. স্কুলে মানসিক সহায়তা সহজলভ্য করা জরুরি
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলর বা মনোবিদের উপস্থিতি স্কুলে অত্যন্ত দরকারি। শিক্ষার্থীদের এমন জায়গা দরকার যেখানে তারা খোলামেলা কথা বলতে পারে, বিচার বা শাস্তির ভয় ছাড়াই। এই পরিষেবাগুলো শুধুমাত্র বিপর্যস্তদের জন্য নয়, সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত।
৪. বিশ্রাম ও শখের জায়গা থাকুক রুটিনে
চব্বিশ ঘণ্টার পড়াশোনার রুটিন মনোযোগ কমায়, ক্লান্তি বাড়ায়। পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরচর্চা ও খেলার সময় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এগুলো সময় নষ্ট নয় বরং মস্তিষ্কের সঠিক কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয়।
৫. কথা বলার খোলা পরিবেশ তৈরি করুন
শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো অনুভব করে যখন তারা নিজেদের দুশ্চিন্তার কথা বলতে পারে। অভিভাবক ও শিক্ষকরা যদি না ঠেলে দিয়ে, বরং মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারেন, তাহলে সেই মানসিক চাপ অনেকটাই হালকা হয়।
৬. সফলতার মানদণ্ড পুনর্বিবেচনা করুন
শুধু পরীক্ষা নয়, প্রকল্প, দলগত আলোচনা, উপস্থাপনা ও শ্রেণিকক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেও শেখার মান নিরূপণ করা যায়। এতে শিক্ষার্থীরা ভয়ের পরিবেশ ছাড়াই নিজেদের মেধা প্রকাশ করতে পারে।
৭. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিন মানসিক সংকট শনাক্তে
শিক্ষার্থীর আচরণ, মনোযোগ কিংবা কার্যক্রমে হঠাৎ পরিবর্তন মানসিক উদ্বেগের ইঙ্গিত হতে পারে। শিক্ষকরা যদি আগেভাগে এই লক্ষণগুলো ধরতে পারেন, তাহলে সঠিক সময়ে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়।
৮. অভিভাবকদের সহায়তা হোক চাপমুক্ত
অনেক অভিভাবক মনে করেন চাপ দিলে শৃঙ্খলা আসে। বাস্তবে সেটা ভয় তৈরি করে। আগ্রহ ও উৎসাহ দিন, কিন্তু প্রগতি নিয়ে প্রতিনিয়ত হিসেব না করে শিক্ষার্থীকে একটি নির্ভরযোগ্য পরিবেশ দিন।
৯. ডিজিটাল অতিরিক্ততা নিয়ন্ত্রণ করুন
সোশ্যাল মিডিয়া ও ফোনের একটানা ব্যবহার শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদের সঙ্গে তুলনা বাড়ে, মনোযোগ বিভ্রান্ত হয়। সময় নির্ধারণ করে স্ক্রিন ব্যবহার এবং অনলাইন চাপ কমানো দরকার।
১০. প্রতিযোগিতাভিত্তিক নয়, সহযোগিতামূলক শেখার পরিবেশ গড়ুন
যেসব স্কুল আলোচনা, দলগত কাজ ও পারস্পরিক শেখাকে গুরুত্ব দেয়, সেখানে শিক্ষার্থীরা উন্নতির সুযোগ পায় "কারও চেয়ে ভালো হতে হবে" এই মানসিকতা ছাড়াই। এতে তারা নির্ভয়ে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে পারে।
শিক্ষার্থীদের মানসিক উদ্বেগ নিজে থেকে কমে না। এর মোকাবিলায় দরকার সচেতনতা, খোলা যোগাযোগ আর সহানুভূতিশীল পরিবেশ। যখন স্কুল ও পরিবার শুধু ফলাফল নয়-চেষ্টা, ভারসাম্য ও সুস্থতাকেও গুরুত্ব দেয়, তখন শিক্ষার্থীরা খোলামেলা, স্বাভাবিক ও স্থায়ীভাবে ভালো করতে পারে।
স্বাস্থ্যবান মন ও শরীরই একজন শিক্ষার্থীর দীর্ঘমেয়াদি সফলতার প্রকৃত ভিত্তি। তাই চাপ নয়, বরং বোঝাপড়ার হাত ধরে হোক তাদের শিক্ষাজীবনের পথচলা।
সূত্র:https://tinyurl.com/ydnpj2e3
আফরোজা