
ছবি: সংগৃহীত
সে দশ বছরের এক বালিকা। স্কুলব্যাগে প্রজাপতির স্টিকার, পরনে উজ্জ্বল নীল জামা, চোখে ফুলেল নকশার চশমা। আত্মপ্রকাশে সাবলীল, অথচ অন্যের দৃষ্টি বা প্রশংসায় পড়ে যায় অস্বস্তিতে। দোকানের সামনে কয়েকজন বড় মানুষ যখন বলে উঠল—"ওহ, তোমার জামাটা কত সুন্দর!"—সে মাথা নিচু করে ফেলে, মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তার মা বুঝতেই পারেন না, নিজে থেকেই সে এত রঙিন পোশাক বেছে নেয়, অথচ প্রশংসা শুনে কেন সংকুচিত হয়ে পড়ে!
এই দ্বৈততার নাম—আত্মপরিচয়ের সূচনালগ্নে লজ্জাবোধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের অনেকেই নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক বা চেহারায় প্রকাশ ঘটালেও, বাইরের প্রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি থাকে না। অভিভাবকের সামনে তখন এক কঠিন প্রশ্ন—তবে কি তাকে বলব, কম নজর কাড়তে হলে, কম রঙিন জামা পরো?
শিশুরা যখন নিজের পছন্দমতো পোশাক বেছে নেয়, সেটা আসলে তাদের নিজস্ব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সমাজের প্রতিক্রিয়া বা প্রশংসা অনেক সময় তাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এতে শিশুকে দায়ী না করে বরং তাকে শেখাতে হবে—এই অনুভূতি স্বাভাবিক, এবং প্রশংসাকে কীভাবে গ্রহণ করতে হয় তা-ও শেখা জরুরি।
জেমা নামের ওই মেয়ের গল্প বলছিলেন তার মা—ও নজরে পড়তে চায় না, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। আমি দ্বিধায় ছিলাম—ওকে বলব কি না, যেন একটু ‘নিরপেক্ষ’ জামা পরে। কিন্তু বুঝলাম, সেটা ওর আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানবে।
এই দ্বিধা থেকেই উঠে আসে সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। একজন মানুষ যদি অন্যদের দৃষ্টিগোচর হতে চায় না, তবে কি নিজেকে প্রকাশ করাও বন্ধ রাখতে হবে? বিশেষ করে একজন শিশু?
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, না। বরং এই সময়টাই শিশুকে শেখানোর—প্রশংসা কীভাবে গ্রহণ করতে হয়, কীভাবে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করতে হয়, এবং কীভাবে আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সমাজে চোখ মেলাতে হয়।
এর জন্য অভিভাবকরা কিছু প্রস্তুত মন্তব্য শেখাতে পারেন শিশুকে, যেমন:
“ধন্যবাদ!”
“হ্যাঁ, এটা আমার প্রিয় জামা।”
“আমি একটু লজ্জা পাই, তাই মুখে কিছু বলি না।”
এই ছোট ছোট বাক্যেই শিশুর সামাজিক আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠতে পারে।
শিশুরা কখনোই একদিনে পরিপক্ক হয় না। তারা তৈরি হয় ধীরে ধীরে, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, কথাবার্তা ও প্রতিক্রিয়া থেকে। রঙিন জামা, অদ্ভুত চশমা কিংবা অচেনা দৃষ্টির মুখোমুখি হওয়া—সবই সেই প্রস্তুতির অংশ। এবং অভিভাবকের দায়িত্ব, শিশুর হাতে সেই প্রস্তুতির হাতিয়ার তুলে দেওয়া।
শেষ পর্যন্ত, এটা পোশাক নয়, ভবিষ্যতের সমাজচিন্তা গঠনের গল্প।
এসএফ