ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা শাহেলা বেগম

তাহমিন হক ববী 

প্রকাশিত: ০০:৫০, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩

বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা শাহেলা বেগম

শাহেলা বেগম

তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তবে সে সময় নির্যাতনে শিকার অনেক নারীর গল্প আরও বেশি বিভীষিকাময়। দেশের জন্য পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে যেসব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের একজন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ধর্মপাল ইউনিয়নের পাইটপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল বাকির স্ত্রী বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা  মোছা. শাহেলা বেগম। 
সম্প্রতি তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, একাত্তরের সেই রোমহর্ষক কাহিনী। দেশের জন্য সম্ভ্রম হারিয়েছেন তিনি। স্বামী মেনে নেন। হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আগুনে বিভিন্ন সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করি। কাছাকাছি দূরত্বে নিজেই অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খাদ্য ও পানি পৌঁছে  দিয়েছি। 
 শাহেলা বেগম বলেনÑ ’৭১ সালের বর্বরতার কথা মনে হলে আঁতকে উঠি। নিষ্ঠুরতায় মুষড়ে পড়েছিলাম, বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিলাম, বীভৎসতায় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তখন বয়স ছিল ১৬ বছর। সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। নববধূর ছোঁয়া শরীরজুড়ে। এখন পাওয়ারের চশমা চোখে। ঝরা ফুলের বেদনা বুকে নিয়ে যতই চোখ মুছেন না কেন স্মৃতির কথা বারবার জ্বলে ওঠে মনের মাঝে। ওই তো বাড়ির উঠনে খানসেনাদের পায়ের বুটের ছাপ।

ইচ্ছা করে সেখানে কোঁদাল দিয়ে কোপাই। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনটি রাত পাকিসেনাদের কাছে সম্ভ্রম হারানো। ওরাতো (হানাদার বাহিনী) আর টিকতে পারল না। পালিয়ে গেল- দেশ স্বাধীনতার জন্য আমরা কেউ পিছপা হইনি। শেখ মুজিবের দেশ পেয়েছি বাংলাদেশ। সেই দেশের একজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার খেতাপ পেলাম। এতেই বুকটা গর্বে ভরে যায়। বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা মোছা. শাহেলা বেগম। তার বীরাঙ্গনার গেজেট নম্বর ১৯৪। আলাপচারিতায় কথা উঠতেই মুখটা মলিন হয়ে যায় তার। তিনি বললেন, বিয়ে হয়েছে সবে আড়াই মাস। তার মধ্যে লেগে গেল স্বাধীনতা যুদ্ধ। হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়েছে। সবাই বলাবলি করছিল সৈয়দপুর ক্যান্টনম্যান থেকে ওরা জলঢাকা দখলে নিয়েছে।

বাঙালি যুবকদের পেলেই গুলি করে মেরে ফেলছে। যে যেমন করে পারছে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। আমার স্বামী বলছিল আমরা গ্রামে থাকি, রাস্তাঘাট ভালো না। এদিকে হানাদাররা আসতে পারবে না। সরল মনে তাই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তাও করেননি তিনি (স্বামী)। এর মধ্যে খবর পেলাম জলঢাকার গোলনা কালীগঞ্জে ভারত পালিয়ে যাওয়ার সময় হানাদার বাহিনীরা তিন শতাধিক বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছে। মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেলেও ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না স্বামী। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাহেলা বেগম। চোখের চশমাটা নামিয়ে চোখ মুছলেন। এরপর জানালেন সেই বিভীষিকাময় তিন দিন তিন রাতের কথা। 
সেদিন, দিন শেষে সন্ধ্যা নেমেছে। স্বামী ও দেবর বাড়ির গরু-ছাগল গোয়াল ঘরে রেখে হাত-মুখ ধুলেন। তাদের চা ও মুড়ি খেতে দিলাম। এরপর রাতের ভাত রান্নায় বসলাম। এরমধ্যে স্বামী ও দেবর রেডিওর খবর শুনতে চলে যায় গ্রামের অদূরে একটি মুদিদাকানে। রান্না শেষ হতে তাদের ডাকতে বের হলাম বাড়ি থেকে। বাড়ির বাহিরে এসেই দেখি বেশকিছু গাড়ির লাইট গ্রামের দিকে ছুটে আসছে। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল হানাদার বাহিনী। তারা আমার স্বামীকে খুঁজছিল। কোনো সারা শব্দ না পেয়ে ঘরের দরজাটা ভেঙ্গে ফেলল। চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকা আমাকে টেনে হেঁচরে বের করে বেঁধে গাড়িতে তুলে নিল। নিয়ে গেল ক্যাম্পে।

সেখানে  তিন দিন তিন রাত আটকিয়ে চলে তাদের পাশবিক নির্যাতন। জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম। জ্ঞান ফিরলেও উঠে বসতে পারতাম না। কথা বলার শক্তিও ছিল না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, চাইতাম তারা যেন আমাকে মেরে ফেলে। কিন্তু না, শুধু আমার সম্ভ্রমকে হত্যা করেছে ওই নরপিচাশ হানাদাররা। এরপর আমাকে অর্ধ মৃত অবস্থায় রাতের আঁধারে গ্রামে ফেলে দিয়ে চলে যায় তারা। চোখ খুলে গ্রামের বেশ কয়েকজনকে দেখতে পেলাম। তারাই খবর দিল আমার স্বামীকে। এরপর আমাকে নিয়ে সেই রাতেই ভারত সীমান্তে নিরাপদে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো।

ভারতের হলদিবাড়ি হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলে। হানাদারদের সেই নির্যাতনে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লাম। বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠল। ওই অবস্থায় প্রতিশোধের আগুনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে লাগলাম।  দেশ স্বাধীন হলো। জন্ম নেয় মেয়ে সন্তান। দেড় মাস বয়সে সে সন্তান মারা গেল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  বীরাঙ্গনা সম্মান প্রদান করে গেছেন।
বলাবাহুল্য যে, ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সম্মান জানান। তার নির্দেশনায় বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়, যা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের আগ পর্যন্ত চলছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও আসে। মুক্তিযুদ্ধের চারদশক পর ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। পরের বছরের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ওই প্রস্তাব পাস হয়। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৫৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শাহেলা বেগমকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
শাহেলা বেগমের স্বামীর সংসারে তিন মেয়ে এক ছেলে। তবে স্বামী আর বেঁচে নেই। জটিল রোগে মারা গেছেন তিনি। ২০২০ সালে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অপরাজিতার মঞ্চে বিশাল আয়োজনে শাহেলা বেগমকে সম্মাননা দিয়েছিলেন নীলফামারী জেলা প্রশাসন। এরপর  সরকারিভাবেও সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। বর্তমান সরকারের পক্ষে এখন প্রতি মাসে সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ নিয়মিত ভাতা পান তিনি।

×