
সবিতার সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন এখন নজরকাড়া। সমসংখ্যক নারী যদি পিছনে থেকে যায় তাহলে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি দৃষ্টিগোচর হতে আরও সময় লেগে যেত। সঙ্গত কারণে দেশের উদীয়মান নারীশক্তি তাদের সর্ববিধ ক্ষমতা ও যোগ্যতা নিয়ে সামনে চলে আসা এখন আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার নিয়ামক শক্তি। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মহাপরিকল্পনায় নারীদের সফলতা এখন দৃষ্টিগোচর। তেমন এক নতুন তৈরি হওয়া কর্মক্ষম উদ্যোক্তা সবিতা বসাক। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল নতুন জীবনের চমকপ্রদ গল্প।
টাঙ্গাইলের মেয়ে সবিতা বসাক। বাবা মহাদেব বসাক, মা মায়া বসাক। ২ ভাই ২ বোনের সংসারে সবিতা সবার ছোট। পিতা মহাদেব সাহার ছিল শাড়ির ব্যবসা। আমরা টাঙ্গাইলের শাড়ির গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি যা আজও সেখানকার ক্রমবর্ধমান ঐতিহ্য। তাঁতের শাড়ির ব্যবসা ছিল পারিবারিক বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য। কারণ পিতার মৃত্যুর পর দুই ভাইকে সেই পৈত্রিক ব্যবসার হাল ধরতে হয়েছে। সেসব দেখে দেখেই সবিতার বড় হওয়া। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের সিঁড়ি পার করা। কাকরাইল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন মানবিক বিভাগে। ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করাও শিক্ষাজীবনের পরম মাইলফলক। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ¯œাতক, ¯œাতকোত্তর করা সবিতার উচ্চশিক্ষার পাঠ সমাপ্ত হয় ২০১৮ সালে। তারপর চেষ্টা চলে প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি।
তবে ইতোমধ্যে বিয়ের পিঁড়িতে বসে অন্যের ঘরনি হওয়াও জীবনের প্রয়োজনীয় দিক। শিক্ষার্থী অবস্থায় নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে সংসার পাতানোও নিজেকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলেই শুরু করেন শাড়ির ব্যবসা। কিন্তু সেভাবে সফলতা পাননি। স্বামী নতুন করে এনজিওতে চাকরি নেন। ইতোমধ্যে মাতৃত্বের পরম আবেগে জীবনের অন্য এক ধাপে উত্তীর্ণ হওয়া আলাদা এক অনুভব। আজও ভোলা যায় না নতুন মাতৃত্বের মহিমায় নিজেকে ভরিয়ে তোলা। কিন্তু বেকারত্বের দুর্ভোগ কাটতে আরও কিছু সময় পার করাও যে জীবনের গতি। বিসিএসে সফলকাম হতে না পারার দুঃখ ভুলতে বেশি সময় নষ্ট করেনি। নতুন ব্যবসার দিকে মনোযোগ তৈরি হয়। সেটা আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। আলুর চিপস। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে সব কিছুর দাম বাড়লেও মূলত আলুটাই ধরাছোঁয়ার মধ্যে থেকেছে। সঙ্গে কুমড়ো আর মাশকলাইয়ের ডালের বড়ি।
যার জন্য নতুন ব্যবসায় পুঁজি খুব বেশি লাগেনি। তবে সাড়া পেয়েছেন দারুণভাবে। চমকে যাবার অবস্থা। মাত্র ২ কেজি আলু কিনে ব্যবসার শুভযাত্রা সত্যিই ভাববার মতোই। নিজেরাই বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেন। লাভ লোকসানের কথা বেশি ভাবতেও হয়নি। শ্বশুরবাড়ি বাজিতপুর। সেখান থেকেই তাদের নতুন পণ্য বিক্রির পসরা শুরু করেন। একমাত্র কন্যা সন্তান রায় বসাক। যার নামেই সবিতার পেইজ। ২০২০ সালের করোনার চরম দুর্ভোগে সব কিছুর ওপর যখন অবরুদ্ধতার জাল বিস্তার করা হয় তেমন দুঃসময়ে বেকারত্ব যেমন চেপে বসে সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথও অনেকে খুঁজে পায়। বাসায় বসে নতুন কোনো কাজ শুরু করা যায় কিনা।
সবিতা বসাক তেমন কর্মদ্যোতনায় আগ্রহী হয়ে প্রচলিত, সহজলভ্য আলু দিয়েই তার যে নতুন কাজ শুরু করলেন সেটাই আজ তাকে উদ্যোক্তার কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। আগেই উল্লেখ করা হয় পুঁজিও ছিল সস্তা আলুর নিতান্ত কম। ক্রমান্বয়ে তা হয়ে দাঁড়াল লভ্যাংশের পরম পথযাত্রা। রমরমা ব্যবসা শুরুর গল্প দিলেন এই উদীয়মান উদ্যোক্তা। ১ দিনেই ২ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি। তার মধ্যে অর্ধেকই লাভ মূলত: ১ হাজার টাকা। আর নাকি পেছন ফিরে তাকাননি পর্যন্ত। শুধু সামনে এগিয়ে যাবার সীমাহীন উত্তেজনা আর পরম উৎসাহ উদ্দীপনায় ২০২১ সালে উই-গ্রুপ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রযুক্তির আঙিনায় সম্পৃক্ত হয়ে ব্যবসার সার্বিক নিয়ম কানুন বুঝতে পারাও ছিল এক অপরিহার্য নির্দেশনা। ক্রমান্বয়ে পরিচিতি বাড়তে থাকে। বিক্রিও শুরু করেন সেভাবে।
গ্রাহকদের সাড়া পেতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতেই হয়নি। একসঙ্গে ৪৫ কেজি বিক্রি করতে পারাটাও নতুন জীবন চলার অনন্য সফলতা তো বটেই। এখন প্রতিনিয়তই নতুন তৈরি করা চিপস আর কুমড়োর বড়ি বিক্রি করে যে লভ্যাংশ সংসারে আসে তাতে সচ্ছল, স্বাচ্ছন্দ্যভাবে যাপিত জীবন অতিক্রম করাও নিরবচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে যাওয়া। সবিতা আর কিছু ভাবতেও চাচ্ছেন না। কারণ যে ব্যবসা তাকে জীবনের চাকা ঘুরাতে এতখানি সহায়তা করেছে সেটা অবলম্বন করেই এই উদ্যোক্তা বাকি চলার পথকেও সাবলীল আর অবারিত করতে চান।