
কোমর ব্যথা
বাচ্চা প্রসবের পর মায়েদের কোমর ব্যথা খুব স্বাভাবিক। ৬০ -৭০ ভাগ গর্ভবতী মহিলা কোমর ব্যথায় ভুগে থাকেন। ব্যথা সাধারণত বুকের খাঁচার ১২ তম হাড্ডি বা রিবের নিচে, গ্লুটিয়াল ফোল্ডে হয়ে থাকে। এছাড়াও হার্নিয়েটেড ডিক্স থাকলে ব্যথা থাই, কাফ, হাঁটু এবং পায়ের পাতা পর্যন্ত হতে পারে। এক তৃতীয়াংশ গর্ভবতী মহিলারা খুবই মারাত্মক ব্যথা অনুভব করেন। কোমরের লিগামেন্ট, মাংশপেশী, পেলভিক মাসেল ও পেটের মাংশপেশী গুলো কোমরের স্ট্যাবিলিটি বজায় রাখতে সাহায্য করে। বাচ্চা যখন পেটে আসে মায়েদের শরীর রিলাক্সিন নামক হরমন তৈরী করে। যা মায়েদের লিগামেন্ট, পেলভিক জয়েন্ট রিলাক্স করে এবং বাচ্চা বের হওয়ার প্রোসেস সহজ করে। বাচ্চা প্রসবের পর মায়েদের শারীরিক জটিলতা অর্থাৎ গর্ভবতী অবস্থায় যেসব জটিলতায় ভোগে তা ধীরে ধীরে আগের মতই স্বাভাবিক হয়ে যায় । কিন্তু কোমর ব্যথা সহজে লাঘব হয় না। তবে খুব কমসংখ্যক মায়েদের কোমর ব্যথার জটিলতায় ভুগে না।
আসুন জেনে নেই গর্ভাবস্থা ও তার পরবর্তী সময়ে কোমর ব্যথার কারণ সমূহ
১. প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডকে সাধারণত তিনটি স্টেজকে ভাগ করা হয় । ১ম, ২য়, এবং ৩য় ট্রাইমেস্টার। ৩য় ট্রাইমেস্টার অর্থাৎ শেষ ধাপে কোমর ব্যথা বেশী হয়। মূলত ৫-৭ মাসের মধ্যে ব্যথার অনূভূতি শুরু হয় কারণ এ সময় কোমরের পোশ্চারাল পরিবর্তন হয়, ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২. প্রেগন্যান্সিতে কোমর ব্যথার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হল মেক্যানিক্যাল, হরমোনাল, সার্কুলেটরী এবং মানসিক কিছু ফ্যাক্টর। মেকানিক্যাল কারণের মধ্যে রয়েছে পেটের মধ্যে বাচ্চা বড় হওয়ার কারণে কোমরের সেন্টার অভ গ্র্যাভেটি পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে কোমরে অধিক চাপ পড়ে। কোমরের লোর্ডটিক কার্ভেচার বেড়ে যায় ফলে ইন্টারভাটিব্রাল ডিক্সের উপর চাপ পড়ে, মাসেল স্ট্রেইন হয় এবং সর্বপরি মেরুদন্ডের দৈর্ঘ্যে বা লেন্থ কমে যায়। এছাড়াও পেটের মাংশপেশী যেমন ট্রান্সভার্স অ্যাবডোমিনিস, মাল্টিফিডাস, পেলভিক ফ্লোর এর অনেক স্ট্রেস পড়ে । ফলে মাংশপেশী গুলো অল্পতেই ক্লান্তি বোধ করে। সেজন্য বডি পোশ্চার ধরে রাখতে পারে না এবং কোমর ব্যথা হয় ।
৩. সার্কুলেটরি কারণের মধ্যে রয়েছে প্রসারিত জরায়ু - ভ্যানাকেভার উপর চাপ দেয়, ফলে শরীরে ফ্লুইড রিটেশন বেড়ে যায় এবং অনেক মহিলা ফুলে যায়। এতে পেলভিক ও কোমরের মাংশপেশীতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও নিউট্রিশন পৌঁছায় না ফলে কোমর ব্যথা হয় ।
অনেক সময় মায়েদের কোমর ব্যথা দীর্ঘ দিন থেকে যায়। কেননা অনেক মায়েরা বাচ্চা প্রসবের পর পর অনেক ভারী কাজ করে। সঠিক নিয়ম কানুন মেনে চলে না যেমন সামনে ঝুঁকে ভারী জিনিস বহন করে, স্তন পান করানোর সময় সঠিক ভঙ্গিতে থাকে না ইত্যাদি কাজগুলো করার জন্য কোমর ব্যথা আরও ভায়ানক রূপ ধারণ করে। উন্নত দেশে মায়েরা গর্ভাবস্থায় এবং বাচ্চা প্রসবের আগে প্রি ও পরে পোস্ট ন্যাটাল ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রি এন্ড পোস্ট ন্যাটাল ফিজিওথেরাপি সমন্ধে অনেকেই অবগত নন। সেই জন্য উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মায়েরা বেশি কোমর ব্যথায় ভুগে থাকেন।
চিকিৎসাঃ- বাচ্চা প্রসবের পর কোমর ব্যথা হলে আপনি কোমরের পেছনে নারকেল তেল দিয়ে ঠান্ডা শেক দিবেন। এরপর চিত হয়ে শুয়ে একটি হাত সামনে এনে হাতে ফু দিবেন ও আরেকটি হাত পেটে রেখে বুঝতে পারবেন পেটের মাংস শক্ত হচ্ছে ও ঢিলা হচ্ছে ।এরপর চিত হয়ে শুয়ে হাঁটু সোজা রেখে এক পা ওপরে উঠিয়ে ৫ -১০ সেকেন্ড রাখুন। ঠিক একই ভাবে অপর পা উঠান। দুই পা ভাজ করে বুকের দিকে নিয়ে ৫-১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। ধীরে ধীরে উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাত পেছনে রেখে মাথা এবং কাঁধ উপরে উঠান ৫-১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন এবং এ সকল এক্সারসাইজ দিনে দুই থেকে তিনবার করুন। বাচ্চা প্রসবের পর অনেক মহিলারা ইউরিনারি ইনকনটিনেন্সি বা প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার জটিলতায় ভুগে থাকেন। এক্ষেত্রে কেজেল এক্সারসাইজ খুবই গুরুত্বপূর্ন যা ব্লাডার কন্ট্রোল রাখতে সাহায্য করে। সর্বোপরি গর্ভাবস্থা ও বাচ্চা প্রসবের পর একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এক্সারসাইজ অনুশীলন খুবই গুরুত্বপূর্ন ।
খাদ্য তালিকা : খাদ্য তালিকায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এমন অনেক খাবার আছে যেগুলো ব্যথা নিরাময়ে করে সেই সব খাবার গুলো খাবেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ব্যথা নিরাময়ে কিছু প্রাকৃতিক ঔষধের কথা বলেছেন যেমনঃ মধু (ব্যথার স্থানে মধুর সাথে ভিনেগার মিশিয়ে মাখালে ব্যথা কমে),খেজুর, কালো জিরা, ওলিভ অয়েল,তরমুজ, চেরী ফল, কালো আঙ্গুর, কলা ইত্যাদি খাবার ব্যথা নিরাময় করতে সাহায্য করে। এছাড়াও লাল আটার রুটি, লাল চালের ভাত খান, প্রচুর পানি পান করুন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট গাঁয়ে রোদ লাগান। প্রতিদিন ৪০ মিনিট হাঁটুন। ধূমপান বর্জন করুন।
ফিজিওথেরাপি পার্শ্বপতিক্রিয়া হীন যুগান্তকারী চিকিৎসা। ফিজিওথেরাপি ইজ মেডিসিন ফোর টুডে এন্ড টুমোরো। নিয়মিত এক্সারসাইজ ব্যথা কমায়, রক্তের সঞ্চালন বাড়ায়, হাঁড়ের ডেনসিটি বেড়ে যায় এবং জয়েন্ট রিলেটেড বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করে। এছাড়াও ডিপ্রেশন কমিয়ে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয় যা ব্যথা কমাতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে ।
সর্তকতা : গর্ভধারণের ৬-৮ সপ্তাহ পর মায়েদের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় অবশ্যই মায়ের সঠিক যত্ন নিতে হবে। নিয়মিত চেক আপের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এবং কিছু সর্তকতা পালন করা উচিত। যেমন-
১.বাচ্চা প্রসবের পর ৬-৮ সপ্তাহ সকল প্রকার ভারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
২.সঠিকমাত্রায় সুষমখাবার খেতে হবে। প্রচুর শাকসবজি ফলমূল খেতে হবে।
৩.প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম অথাৎ ৮-১০ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
৪.ভ্যজাইনার আশেপাশে যে সকল জায়গায় ব্যথা সেখানে আইস প্যাক ব্যবহার করতে হবে এবং ভ্যাজাইনা পরিস্কারের সময় হালকা গরম পানি ব্যবহার করতে হবে ।
৫. নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে ।
৬. বাচ্চা প্রসবের পর মায়েদের কোষ্ঠ্যকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় সুতরাং প্রচুর পানি পান করতে হবে ।
প্রফেসর ডা. আলতাফ সরকার
মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজঅর্ডারস বিশেষজ্ঞ
এমএস