সিলেট-সুনামগঞ্জের লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জের লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ এখনও কমেনি। বন্যা পরবর্তী সময়ে নিজেদের পুনর্বাসান নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় দিন অতিবাহিত করছেন শত শত গ্রামের মানুষ। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা আছেন সবচেয়ে বেশি কষ্টে। বন্যায় গবাদিপশু নিয়েও বিপদে পড়েছেন খামারি, গৃহস্থ ও চাষীরা। সামনে ঈদ-উল-আজহা। কোরবানি সামনে রেখে গরু-ছাগলের বাজার রমরমা হয়ে থাকে।
কিন্তু ভয়াবহ বন্যায় ফসলি জমির পাশাপাশি চারণভূমি প্লাবিত হওয়ায় এবং অনেকের চাষ করা ঘাস বন্যায় নষ্ট হওয়ায় পশুখাদ্যের সঙ্কট চরমে। যে কারণে পশুখাদ্যের দামও বেড়ে গেছে। সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন তাই নিজেদের পাশাপাশি পশু নিয়েও সংগ্রাম করতে হচ্ছে মেহনতী মানুষের। এই সংগ্রামে সামনে আছেন নারীরা। নিজের সন্তানের মতোই গবাদিপশুর যতটা সম্ভব যত্ন করছেন ঈদে ভাল দাম পাওয়ার আশায়।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুঃখী মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের করুণ অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে। সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নের একাধিক গ্রামের সংগ্রামী নারীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। সেখানে সুফিয়া খাতুন, জমেলা বেগম, মায়াবতী রানীরা জানিয়েছেন তাদের দুঃখ, কষ্ট আর সংগ্রামের কথা।
বেদনার্ত কণ্ঠে সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে। দুই মেয়ে, এক ছেলে, শাশুড়ি নিয়ে আমার পরিবার। স্বামী না থাকায় আমাকেই সংসার চালাতে হয়। ছেলেমেয়েরা ছোট। কিভাবে যে সংসার চলে তা আমি আর আল্লাহ জানেন। বন্যা আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে গুরু-ছাগল লালনপালন করি। ঈদে বিক্রি করব ভেবে দুটি গরুকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করছি।
বন্যার মধ্যেও ওদের ছেড়ে আমি আশ্রয় কেন্দ্রে যাইনি। অনেক কষ্টে গরু দুটিকে আগলে রেখেছি। কিন্তু এখন ওদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারছি না। কোথা থেকে আসবে খাবার; কে দেবে! ভেবেছিলাম ঈদে ভাল দাম পাব। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে ওদের বাঁচিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।’
সুফিয়ার মতো এমন সংগ্রামী জীবন বন্যায় ক্ষতি হওয়া হাজারও মানুষের। একেকজনের কষ্ট একেকরকম। এই যেমন মায়াবতী রানী বলেন, ‘যার কষ্ট তারই থাকে। মাঝেমধ্যে কিছুটা সহায়তা পেয়েছি কিন্তু তাতে তেমন কিছুই হয় না। আমরা মানুষ তাও অনেক কিছু বলতে পারি সইতে পারি। কিন্তু অবলা পশু তারা তো কিছুই বলতে পারে না।
বন্যায় তাদের যে কতটা কষ্ট হলো বোঝাতে পারব না। ঠিকমতো খাবার দিতে পারছি না। বাঁচিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ বন্যা পরবর্তী সময়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম চলছে। বন্যার্ত মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন।
যেমন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার জ্ঞানের আলো পাঠাগারের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের সহায়তার জন্য সংগঠনটির ১০ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক টিম গত ২৬ জুন থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় কাজ করে। সেখানে টানা এক সপ্তাহ বন্যার্তদের পাশে ছিল উদ্যোমী এই টিম। জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান পারভেজের নেতৃত্বে এ টিমে ছিলেন পল্লী চিকিৎসক ও ফার্মাসিষ্ট দিদারুল আলম খান, সদস্য জোবায়ের রিফাত, সজিব শেখ, আব্দুর রহমান, হাসান শেখ, জোভান আহমেদ, ফোরকানুল হামিদ, আবু সাইদ ও জিয়াদুল ইসলাম।
তাহিরপুর উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নের ১০০০ দরিদ্র পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে এই টিম। প্রতি পরিবারকে দেয়া হয় চাল, ডাল, তেল, লবন, আলু, পেঁয়াজ ও সাবান। প্রায় ১ হাজার রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। ৫০০ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয় শিক্ষা উপকরণ। ৫০০ ব্যক্তিকে দেয়া হয় বিভিন্ন ধরনের পোষাক। এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান কবির।
সিলেটের কোম্পানিগঞ্জের বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন ইমতিয়াজ সুলতান নামের এক তরুণ। অসহায় মানুষ ও গবাদিপশুর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা বন্যাকবলিত ছামারাকান্দি, ফেদারগাঁও, বেতমুড়া, ছগাম, হুড়ারপাড়, সালুটিকর, খাগাইলসহ অনেক গ্রাম ঘুুরে দেখেছি। সবখানে অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কোন রকমে মাথা গুজে আছে সবাই। বিশুদ্ধ খাবারের সঙ্কট চরমে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুরও অবর্ণনীয় কষ্ট দেখেছি। অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশু সঙ্গে করে এনেছেন। বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর নিজ নিজ বাড়িতেও ফিরছেন সবাই। কিন্তু সেখানে নিজেদের সঙ্গে গবাদিপশুর খাদ্য সঙ্কটও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।’
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার গৃহিণী মরিয়ম আক্তার বলেন, ‘এক বেলা খাবার পেলে দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। মানুষের মতো গরু-ছাগলেরও একই দশা। তবে অবলা প্রাণীকে যতটা সম্ভব যতœ করার চেষ্টা করছি। ওরা তো আর কষ্টের কথা বলতে পারে না। এখন এত কষ্ট করে যদি কোরবানিতে ভাল দাম পায় তা হলে কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে।’
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একজন নারী কর্মী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘হিসাব করা কঠিন কে ভাল আর কে খারাপ আছে। সবাই এখন এক কাতারে। মানুষ, গবাদিপশু সবাই এক কাতারে। সবাই যে কতটা অসহায় সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।’