ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ

প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ২১ অক্টোবর ২০১৯

 প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কে  সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, বিষণ্ণতা থেকে ছুটি পেতে চাইলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে বিকল্প কিছুই নেই। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য এর চেয়ে ভাল ওষুধ যে নেই, তা অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত। যদি এ বিষয়টি আপনি মানতেই না চান তাহলে বলুন তো, আপনি যখন বেড়াতে যান পাহাড়ের কোলে বা সাগরের গর্জনের মাঝে অথবা ঘন সবুজ অরণ্যে, তবে কেন আপনার মন ভাল হয়ে যায়? এই ব্যাখ্যা কি আপনার কাছে আছে? আসলে বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির দৌড়ের মাঝে আমরা কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে আমাদের মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি বেশিরভাগ সময়েই আমাদের দৈনন্দিন নানা জটিলতায় ফেলে দেয়। আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন, যারা সামান্য মানসিক চাপে একেবারেই ভেঙে পড়েন। আবার অনেকেই আছেন সামান্য অসুস্থতায় ওষুধ বা ডাক্তারের দ্বারস্থ না হয়ে পারেন না। আমাদের আশপাশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। সমস্যা থেকে যায় সমস্যার আড়ালেই, সমাধানের পথ আর বেরোয় না। এসবের সমাধান কিন্তু আমাদের হাতেই আছে। অনেকেই জানেন না, প্রকৃতি এক্ষেত্রে আমাদের কতটা উপকার করে থাকে। বলতে গেলে আমাদের শারীরিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে মানসিক সমস্যাসহ সকল কিছুর সমাধান প্রকৃতির মধ্যেই বিরাজমান। গবেষকরা জানিয়েছেন, নিজেকে চাপমুক্ত রাখতে চাইলে প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে কাটানো উচিত। প্রকৃতির নিবিড় ভালবাসার হাতছানিতে কিছুটা সময় জিরিয়ে নিতে পারলে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠবেই। প্রকৃতি কীভাবে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে, চলুন সে সম্পর্কে জেনে নিই। শর্টটার্ম মেমরি ইম্প্রুভমেন্ট মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিজ্ঞানী কিছু মানুষের ওপর জরিপ চালান। গবেষণার জন্য এসব মানুষদের দুই ভাগে ভাগ করে একদলকে সবুজ ছায়ায় ঘেরা উদ্যানে, আরেক দলকে শহরের চেনা পরিবেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যখন তারা ফিরে আসেন, তখন তাদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, যারা সবুজের মাঝে ছিলেন, তাদের স্মৃতিশক্তি আগের তুলনায় ২০ শতাংশ উন্নতি ঘটেছে। আর যারা ছিলেন শহরের পরিবেশে, তাদের কোন উন্নতিই ঘটেনি। এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রকৃতি মানুষকে তার স্মৃতি পুনরুদ্ধারে কতটা সাহায্য করে থাকে। মানসিক উন্নতি ও পুনর্গঠন ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত পরিবেশ বিষয়ক এক মনোবিজ্ঞান জার্নালে বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন ‘মানসিক ক্লান্তি’ নামে। গবেষকরা দেখেছেন, কোন মানুষ যদি প্রকৃতির কোন ছবির দিকেও মনোযোগ দেয়, তাহলেও তার স্মৃতি কিছুটা সতেজ হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, ছবি না হয়ে তা যদি সত্যিকারের প্রকৃতির সান্নিধ্য হতো, তাহলে তার প্রভাব কত বেশি হতো? মানসিক চাপ কমায় এবং মনোযোগ বাড়ায় প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় প্রমাণ দিয়েছেন, মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতার মতো মানসিক ব্যাপারগুলোর সবচাইতে বড় ওষুধ হচ্ছে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা। গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী, মানসিক চাপগ্রস্ত ব্যক্তি চরম হতাশ মুহূর্তে মাত্র ১০ মিনিটের জন্যও যদি কোন পার্ক বা খোলামেলা হাওয়াযুক্ত সবুজ পরিবেশ থেকে হেঁটে আসেন, তাহলেও তার মানসিক বিকারগ্রস্ততা কিছুটা সময়ের জন্য হলেও উপশম হয়। কারণ, এতে মস্তিষ্কে তৈরি হয় কিছু ভাললাগার হরমোন এবং তা মানসিক চাপ উপশমে অসাধারণ কাজ দেয়। মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সবুজের কাছাকাছি থাকুন ১৯৯৫ ও ২০০৮ সালে প্রকাশিত এক জার্নালে ডাচ গবেষকরা ২,৫০,৭৮২ জন লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলে জানিয়েছেন, গ্রামাঞ্চলের লোকেরা বেশি সবুজ আবহাওয়ায় থাকেন। কিন্তু যারা শহরাঞ্চলে ইট-কাঠ-পাথরের মাঝে জীবনযাপন করেন, তাদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষজন বেশি দীর্ঘায়ুসম্পন্ন এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকেন। তাদের মানসিক পীড়া তুলনামূলক কম থাকে। এটিই তাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার মূল কারণ। ক্যান্সার প্রতিরোধে কঠিন অসুখ থেকে সেরে ওঠার জন্য অনেক সময় ডাক্তাররা প্রেসক্রাইব করে থাকেন রোগী যেন পছন্দসই কোন ছায়া নিবিড় শান্ত পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে আসেন। এ কথার পেছনে রয়েছে খুব সুন্দর যুক্তি ও নানা গবেষণালব্ধ ফলাফল। জাপানের কয়েকজন গবেষক বিষয়টির ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ, বনের সবুজ ছায়া, পাখির কিচির-মিচির ইত্যাদি বিষয়গুলো ক্যান্সার প্রতিরোধী প্রোটিনকে উদ্দীপ্ত করে থাকে। তাতে প্রাথমিক ধাপে থাকা ক্যান্সার উপশম সত্যি সম্ভব। তাছাড়া গবেষণায় আরও দেখা গেছে, চেইন স্মোকাররা তাদের অতিরিক্ত ধূমপানের অভ্যাস থেকে মুক্তিলাভের জন্য যদি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পারেন, তাহলে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা বৃদ্ধিতে তাইওয়ানের কয়েকজন বিজ্ঞানী একটি স্কুলের শিশুদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন যে, স্কুলের ১২ বছরের মধ্যকার বেশিরভাগ শিশুই কঠিন মায়োপিয়া রোগে আক্রান্ত। মায়োপিয়া হলো এমন একধরনের চোখের অসুখ, যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমশ কাছের জিনিস কম দেখতে শুরু করেন। তখন তাদের চশমা ব্যবহার করতে হয়। গবেষকদল ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের আউটডোর এ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। এক বছর পর তার ফলাফল হলো, মায়োপিয়া আক্রান্তের হার ১৭.৬৫% এ নেমে এসেছে; তার মধ্যে প্লে আউটসাইড স্কুলগুলোতে ৮.৪১% পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাচ্চারা আউটসাইডে খেলাধুলা বা বেড়াতে যাওয়ার বেশিরভাগ সময়টাতেই প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকে। সুতরাং বাচ্চাদের সুস্থ-স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে প্রকৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।
×