ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২

প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নে লাথি মারছে লাবুবু পুতুল

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ৭ আগস্ট ২০২৫

প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নে লাথি মারছে লাবুবু পুতুল

ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবী যখন প্লাস্টিক দূষণ ঠেকাতে জাতিসংঘের নেতৃত্বে জেনেভায় বৈশ্বিক চুক্তির আলোচনায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই এক অদ্ভুত ট্রেন্ড সেই উদ্যোগকে কার্যত ধাক্কা দিয়ে চলছে, লাবুবু পুতুল। ভয়ঙ্কর-কিউট এই পুতুলটি তৈরি হয় মূলত পলিয়েস্টার ও পলিভিনাইল ক্লোরাইড দিয়ে। এটি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং এবং দ্রুতই জনপ্রিয় হচ্ছে শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষের মধ্যে। তবে সমস্যা শুধু এই খেলনা বা ভাইরাল পণ্যে সীমাবদ্ধ নয়—বিষয়টি অনেক বেশি গভীর ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গড়িয়েছে।

বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে চীনসহ বড় বড় তেল ও পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানিগুলো এখন ব্যাপক অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে প্লাস্টিক উৎপাদনের মূল কাঁচামাল, এথিলিন ও প্রোপিলিন তৈরির জন্য। যেমন, সম্প্রতি শানডং ইউলং পেট্রোকেমিক্যাল ঘোষণা দিয়েছে তারা ১৬.৪ বিলিয়ন ডলারে একটি বিশাল প্লান্ট নির্মাণ করবে। একইভাবে পেট্রোচায়না বিনিয়োগ করছে ৯.৬ বিলিয়ন ডলার। শুধু চীন নয়, এই শিল্পে যুক্ত হয়ে পড়েছে সৌদি আরবের সাবিক, ইউরোপের শেল, বিএএসএফ এবং অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানও।

২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে চীনে এথিলিন উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ মিলিয়ন মেট্রিক টনে। পূর্বাভাস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ৩৩ মিলিয়ন টন উৎপাদন যুক্ত হবে। মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারেও চীন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে যেখানে তা ছিল ৭৬ কেজি, যা জাপানের ৮২ কেজির খুব কাছাকাছি। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে এটি ১১৫ কেজি, তথাপি চীনের প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে চীনের প্যাকেজিং খাতে প্লাস্টিকের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে, ২০২২ সালের পর এক্সপ্রেস ডেলিভারির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যদিও সরকার মাঝে মাঝে বর্জ্য হ্রাসের ঘোষণা দেয়, বাস্তবে কার্যকর উদ্যোগের অভাব স্পষ্ট।

এর চেয়েও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—বিশ্ব যখন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ রক্ষার পথে হাঁটছে, ঠিক তখনই সেই পরিবর্তন থেকে সৃষ্ট নতুন রাসায়নিক উৎপাদন চক্র আমাদেরকে আরও প্লাস্টিক নির্ভর করে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ, তেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত ন্যাপথা ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপন্ন ইথেন, প্রোপেন—এসব এখন প্লাস্টিকের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে প্রতি তিন ভাগ তেলের এক ভাগই আসে ন্যাচারাল গ্যাস লিকুইডস (NGL) থেকে।

চীনে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে এই NGL উপাদান, যা এখন সয়াবিন ও অপরিশোধিত তেলের পর তৃতীয় স্থানে। মার্কিন সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ইথেন রপ্তানি ৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে। এর অন্যতম কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে অন্যান্য পণ্যের ওপর শুল্ক থাকলেও NGL উপাদানগুলো সেই শুল্কের আওতায় পড়ে না।

এই বাস্তবতায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে হওয়া বৈশ্বিক প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি আদৌ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। গত বছরের বুসান সম্মেলনেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এবারের জেনেভা বৈঠকেও আশাব্যঞ্জক কিছু দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্বের শক্তিশালী গবেষণা প্রতিষ্ঠান Wood Mackenzie জানিয়েছে, বর্তমানে এথিলিন উৎপাদনে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে অন্তত ৫৫ মিলিয়ন টন প্লান্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ইউরোপ, যেখানে ৪০ শতাংশ প্লান্ট ঝুঁকির মুখে। তবে ইউরোপ তুলনামূলকভাবে ভালোভাবে প্রস্তুত—তাদের উন্নত রিসাইক্লিং ও বর্জ্য পৃথকীকরণ ব্যবস্থা কিছুটা হলেও এই ধাক্কা সামাল দিতে পারবে।

কিন্তু শেষ প্রশ্নটি থেকেই যায়, প্লাস্টিক কমানোর অঙ্গীকার করা যত সহজ, বাস্তবে কোনো পেট্রোকেমিক্যাল প্লান্ট বন্ধ করা, ইথেন রপ্তানি বাতিল করা বা একটি তেল শোধনাগার বন্ধ করে দেওয়া ততটাই কঠিন।

মুমু ২

×