
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা দুই দেশের সম্পর্ককে বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে নীচু পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারত এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ শুল্কহারভুক্ত কয়েকটি দেশের মধ্যে পড়েছে।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে, রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এতে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে। প্রথম ধাপের ২৫ শতাংশ শুল্ক বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে, আর বাকি অংশ কার্যকর হবে আগামী ২৮ আগস্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ দেখায় যে তিনি "বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যের" চেয়ে "নিজ দেশে উৎপাদন" বা অনশোরিং নীতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত অনেককে বিস্মিত করেছে, কারণ ভারত প্রথম থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছিল এবং ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে একে অপরকে ‘বন্ধু’ বলে প্রশংসা করেছেন। বর্তমানে ব্রাজিলই একমাত্র দেশ, যার ওপর ভারতের সমান উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন অব কানাডার ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিনা নাজিবুল্লাহ বলেছেন, “এটি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য খুব কঠিন সময়। বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বলা যায়। এখন তাদের বাস্তবসম্মত পথ খুঁজে বের করতে হবে এবং আস্থা পুনর্গঠনে উদ্যোগ নিতে হবে।”
গত সপ্তাহেই ট্রাম্প সতর্ক করেছিলেন, রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার কারণে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন। তিনি দুই দেশকেই ‘অর্থনৈতিকভাবে মৃত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১.২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারতের পক্ষে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। মোদি ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী পাঁচ বছরে এই বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। আলোচনার সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছিল, প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে আমদানি বাড়ানোর কথাও বলেছিল। এমনকি গাড়ির শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দেয়, যদিও দেশের অটোমোবাইল খাতের চাপ ছিল তীব্র। কিন্তু কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের শুল্ক কমাতে রাজি হয়নি ভারত, কারণ এই খাতগুলো কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবিকার সঙ্গে যুক্ত।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের ফারওয়া আমের বলেন, বিষয়টির সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ইস্যুও জড়িত। মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত শেষে যুদ্ধবিরতিতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি ভারত অস্বীকার করে। পাকিস্তান বরং ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার ঘোষণা দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ ও জ্বালানি খাতে চুক্তি করেছে।
ভারত বলেছে, এই শুল্ক “অন্যায়, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য” এবং রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কেবল ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য। তবে ভারত আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে দুর্বল দেখাতে চায় না।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ রবার্ট রোগোস্কি আশা করছেন, নিকট ভবিষ্যতে উভয় দেশ সৃজনশীল কূটনীতির মাধ্যমে সম্পর্ক পুনর্গঠনে এগিয়ে আসবে।
এদিকে, ভারত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চলমান আলোচনায় মনোযোগ দিচ্ছে। একইসঙ্গে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। মাসের শেষে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলনে যোগ দিতে মোদি চীন সফরে যাবেন, যা ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর প্রথম সফর হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আঘাত ভারতের শিল্পখাতের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। অ্যাপল ঘোষণা দিয়েছিল, আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির সব আইফোন ভারতে তৈরি হবে। যদিও ইলেকট্রনিকস পণ্যে এখনো শুল্ক আরোপ হয়নি, তবুও ৫০ শতাংশ শুল্কহারবিশিষ্ট দেশ হিসেবে ভারতের প্রতি বৈশ্বিক ব্যবসায়িক আস্থা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নাজিবুল্লাহ বলেন, “ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তিনি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বাণিজ্যের চেয়ে নিজের দেশে উৎপাদন বাড়াতেই বেশি মনোযোগী।”
সূত্র: আল জাজিরা
এম.কে.