
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত ঘিরে দুই দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় মূলধারার কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একতরফা ও যাচাইবিহীন তথ্য অনেক বিশেষজ্ঞকেই উদ্বিগ্ন করেছে।
গত ৭ মে রাতে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীর এলাকায় ভারত একটি সীমিত সামরিক অভিযান চালানোর দাবি করে। ভারতীয় কিছু টিভি চ্যানেল এ ঘটনাকে ‘সফল প্রতিরোধমূলক হামলা’ হিসেবে বর্ণনা করে। ভারতে পাকিস্তানি টেলিভিশন নিষিদ্ধ থাকায় ভারতীয় নাগরিকদের জন্য পাকিস্তানের অবস্থান জানা ছিল কঠিন।
অন্যদিকে পাকিস্তানেও গুজব ছড়ায় যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কারণ ভারতীয় ড্রোন পাকিস্তানের আকাশসীমায় দেখা গেছে। অথচ সরকারি পর্যায়ে সে সময় কোনো নিশ্চিত বার্তা না আসায় বিভ্রান্তি তৈরি হয় বলে জানায় পাকিস্তানি গণমাধ্যম দ্য ডন।
মিডিয়ায় ভুয়া ও অতিরঞ্জিত খবর
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮ মে রাতে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো দাবি করে পাকিস্তান নাকি অমৃতসরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। পরে পাকিস্তান দাবি করে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আসলে ভারতের ভেতর থেকেই উৎক্ষেপণ হয়েছিল।
ডন জানায়, এরপর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে একাধিক অসংগতিপূর্ণ খবর দেখা যায়— যেমন করাচি বন্দরে হামলা, লাহোরে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রসর হওয়া, কোয়েটা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে যাওয়া কিংবা ইসলামাবাদে ভারতের পতাকা উত্তোলন। যদিও এসব খবরের কোনো নিরপেক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।
পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর থেকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ভিডিও ভাইরাল হলে এসব দাবি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের মুখে পড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধকালীন সময়ে গুজব এবং অতিরঞ্জিত সংবাদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ
গত এক দশকে ভারতের স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিসর উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত হয়েছে— এমনটি মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডন দাবি করে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে কিছু প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম, যেমন এনডিটিভি, মালিকানা পরিবর্তনের মাধ্যমে চাপের মুখে বিক্রি হয়ে যায়। অন্য অনেক গণমাধ্যমকে নীতিগতভাবে সরকারি অবস্থান মেনে চলতে দেখা গেছে।
ডন জানায়, এই প্রেক্ষাপটে ভারতে একটি নতুন পরিভাষা প্রচলিত হয়েছে— ‘গোদি মিডিয়া’। এটি প্রধানমন্ত্রী মোদির নামের সঙ্গে হিন্দি/উর্দু শব্দ ‘গোদি’ (অর্থাৎ কোলে বসা) মিলিয়ে তৈরি, যার মাধ্যমে বোঝানো হয় এমন গণমাধ্যম যারা সরকারি মতাদর্শের প্রতি অতিরিক্ত অনুগত।
বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে গণমাধ্যম মালিকদের প্রভাবিত করা, আর অন্যদিকে স্বাধীন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ চালিয়ে একটি চাপের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। ফলে ভারতে অনুসন্ধানী ও সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা বর্তমানে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে অভিযোগ করে পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডন।
ডন প্রতিবেদনে জানায়, ভারত সরকার ৮ হাজারের বেশি ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে— যার মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, গবেষক ও বিশ্লেষকদের পেজ। এসব পদক্ষেপ নিয়েও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে।
পরিণতি ও পর্যালোচনা
সাম্প্রতিক ঘটনার পর পাকিস্তান পাল্টা সামরিক প্রতিক্রিয়া জানায়, এবং ভারতও কিছু ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করে। তবে এই সংঘর্ষ বাস্তবে যে মাত্রায় ঘটেছে, ভারতীয় মিডিয়ায় তার চেয়ে অনেক বেশি নাটকীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে অভিযোগ করে ডন।
বিশ্লেষকদের মতে, গণমাধ্যমের দায়িত্ব হল তথ্য যাচাই করে জনগণকে সচেতন করা— উসকানি নয়। বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনার সময়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র: দ্য ডন
রাকিব