
দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা প্রশমনে একটি নতুন চুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার দাবি, চীন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরল খনিজ ও ম্যাগনেট সরবরাহে সম্মত হয়েছে, আর এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের হুমকি থেকে সরে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, “চীনের সঙ্গে আমাদের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, শুধু প্রেসিডেন্ট শি এবং আমার চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।”
এই ঘোষণা আসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত দুই দিনের একটি তীব্র আলোচনার পর, যেখানে মে মাসে ঘোষিত সাময়িক যুদ্ধবিরতির পরে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধগুলো নিরসনের চেষ্টা চলছিল। ওই সময় দ্বিপক্ষীয় ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণে দুই দেশের বাণিজ্য কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল।চুক্তির বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা হয়নি, তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মে মাসের যুদ্ধবিরতির কাঠামো বহাল থাকছে। ওই সমঝোতার মাধ্যমে কিছু নতুন ট্যারিফ প্রত্যাহার করা হলেও সম্পূর্ণভাবে তা বাতিল হয়নি।
চীনের উপ-বাণিজ্যমন্ত্রী লি চেংগ্যাং বলেন, “৫ জুনের ফোনালাপ এবং জেনেভা বৈঠকে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে যে ঐকমত্য হয়েছে, তার বাস্তবায়নে উভয় পক্ষ একটি কাঠামোগত সমঝোতায় পৌঁছেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিকও সাংবাদিকদের জানান, “আমরা জেনেভা সম্মেলনের ঐকমত্য বাস্তবায়নের জন্য একটি কাঠামোয় সম্মত হয়েছি। প্রেসিডেন্টদের অনুমোদনের পরই এর বাস্তবায়ন শুরু হবে।”
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাটনিক বলেন, আলোচনার মাধ্যমে জেনেভা চুক্তির অনেক অস্পষ্টতা দূর হয়েছে। “আমরা সঠিক পথে আছি। পুরো বিষয়টা এখন অনেক স্বস্তিদায়ক মনে হচ্ছে,” বলেন তিনি।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চুক্তির খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করছেন। তিনি বলেন, “যেটুকু শুনেছেন, তা তার পছন্দ হয়েছে।”চুক্তির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ছিল যে, চীন ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বিরল খনিজ ও ম্যাগনেট রপ্তানি বিলম্বিত করছে। এই উপাদানগুলো স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক যানবাহন তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে অপরিহার্য।
অন্যদিকে, চীন অভিযোগ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সেমিকন্ডাক্টরসহ নানা পণ্যে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।সিএনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাটনিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কিছু পাল্টা ব্যবস্থা প্রত্যাহারে রাজি হয়েছে, যদিও এসব পদক্ষেপ কী ছিল তা বিস্তারিত বলেননি।
এদিকে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, সাম্প্রতিক আলোচনাগুলো খুবই সীমিত পরিসরে হয়েছে এবং আরও বিস্তৃত একটি চুক্তি করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তার ভাষায়, “এটা একটি অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া হবে।”
চলতি বছরের শুরুতে ট্রাম্প যখন একাধিক দেশের পণ্যে একতরফাভাবে নতুন ট্যারিফ আরোপ করেন, চীন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাল্টা পদক্ষেপে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে, ফলে ‘টিট ফর ট্যাট’ বা পাল্টা ব্যবস্থার এক দুঃসহ চক্র শুরু হয়।
মে মাসে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আলোচনায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি বা ‘টোটাল রিসেট’ ঘোষণা করেছিলেন ট্রাম্প। এতে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনে, আর চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক ১০ শতাংশে নামায় ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানির বাধা হ্রাসে প্রতিশ্রুতি দেয়। উভয় পক্ষ একটি ৯০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে।তবে পরে উভয় পক্ষই অ-শুল্ক প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে।
ট্রাম্প তার পোস্টে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে এখন ৫৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করছে। যদিও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই হার ট্রাম্পের আগের মেয়াদের কিছু ট্যারিফও অন্তর্ভুক্ত করে।
চুক্তির ঘোষণার পর বাজারে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পরামর্শ সংস্থা প্যানজিয়া পলিসির প্রতিষ্ঠাতা টেরি হেইনস মন্তব্য করেন, “চুক্তির ব্যাপ্তি অত্যন্ত সীমিত এবং এখনো অসম্পূর্ণ। জেনেভা ‘বিরতি’র পুনরায় কার্যকর হওয়া ক্ষুদ্র একটি সাফল্য মাত্র এবং এর ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বা ভূরাজনৈতিক চুক্তি খুব শিগগির আসবে, এমনটা ধারণা করা যাচ্ছে না।”
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক যে আগের তুলনায় কিছুটা স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছে, সেটি এই সাম্প্রতিক আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট হলেও, পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী সমাধানের পথ এখনো দীর্ঘ। তবে বিরল খনিজ সরবরাহ এবং শিক্ষার্থী ভিসার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে দুই পক্ষের সম্মতি ভবিষ্যতের বৃহত্তর চুক্তির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র:https://tinyurl.com/3ektc53t
আফরোজা