
ঘুম আমাদের শরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এটি নতুন কিছু নয়। আমরা জানি, পর্যাপ্ত না ঘুমালে হৃদ্রোগ, স্মৃতিভ্রংশ ও মেজাজজনিত সমস্যা হতে পারে। তবে গবেষণায় এখন দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘুম বিশেষত নয় ঘণ্টার বেশি দীর্ঘমেয়াদে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অতিরিক্ত ঘুম: বিশ্রাম না, বরং সতর্কবার্তা?
ঘুম শরীরের রোগ প্রতিরোধ, স্মৃতিশক্তি তৈরি, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং হরমোন ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। অস্ট্রেলিয়ার স্লিপ হেলথ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা গুণগত মানসম্পন্ন ঘুমই যথেষ্ট। তবে কেউ কেউ এর চেয়ে একটু কম ঘুমেও ভালো থাকেন, যদি তাদের ঘুমের মান ভালো হয় এবং দিনভর প্রাণশক্তি থাকে।
ঘুম কম হলে যেমন সমস্যা, বেশি হলেও তেমনি
বিশ্বজুড়ে ২১ লাখেরও বেশি মানুষের ওপর চালানো এক মেটা-অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে, যারা দিনে সাত ঘণ্টার কম ঘুমান, তাদের মৃত্যুঝুঁকি ১৪ শতাংশ বেশি। আবার যারা নয় ঘণ্টা বা তার বেশি ঘুমান, তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশে। ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমকেই দেখা হচ্ছে ‘স্বর্ণসময়’ হিসেবে।
পূর্ববর্তী ৭৪টি গবেষণার পর্যালোচনাতেও একই চিত্র উঠে এসেছে নিয়মিত অতিরিক্ত ঘুম মৃত্যুঝুঁকি বাড়াতে পারে।
অতিরিক্ত ঘুমে মস্তিষ্ক ও শরীরে প্রভাব
নিয়মিত নয় ঘণ্টার বেশি ঘুমালে শুধু আয়ু নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মস্তিষ্ক ও দেহের নানা কার্যক্রম:
-
স্মৃতি ও চিন্তাশক্তি: যারা দীর্ঘক্ষণ ঘুমান, তাদের স্মৃতি, যুক্তি ও স্থান নির্ণয় ক্ষমতা কমে যেতে পারে। বিষণ্নতা থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
-
দীর্ঘমেয়াদি রোগ: অতিরিক্ত ঘুম বিষণ্নতা, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, হরমোনের সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি ও হৃদরোগের সাথে জড়িত।
-
স্ট্রোকের ঝুঁকি: সেমেলওয়েইস ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত উভয় ধরনের ঘুম মৃত্যুঝুঁকি ও স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ায়। বিশেষত, নারীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘঘুমে স্ট্রোকের ঝুঁকি ছিল ৪৬% বেশি।
ঘুম বেশি হওয়া: কারণ না কি উপসর্গ?
বেশি ঘুম মানেই আপনি অসুস্থ, তা নয়। বরং এটি কোনো গোপন সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে:
-
অন্তর্নিহিত অসুস্থতা: হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা, ব্যথাজনিত রোগ বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বেশি ঘুম হতে পারে।
-
খারাপ ঘুমের গুণমান: বিছানায় অনেকক্ষণ থাকলেও যদি ঘুম বিভ্রান্তিকর হয় (যেমন: ঘনঘন জাগা, স্লিপ অ্যাপনিয়া), তাহলে ঘুমের সময় বেড়ে যায়।
-
জীবনযাপন ও অভ্যাস: অলস জীবনযাপন, ঘন ঘন ঘুমানো বা অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচি অতিরিক্ত ঘুমে প্রভাব ফেলে।
বয়স ও ঘুমের চাহিদা
বয়স অনুযায়ী ঘুমের চাহিদাও পরিবর্তন হয়। কিশোরদের সাধারণত ৮–১০ ঘণ্টা দরকার হয়, তবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৭–৯ ঘণ্টা যথেষ্ট। যদি কেউ প্রতিদিন নয় ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়ে তবু ক্লান্ত বোধ করেন, তবে এর পেছনের কারণ খুঁজে দেখা দরকার।
ঘুমের পরিমাণ নয়, মানই মুখ্য
কত ঘণ্টা ঘুমালেন তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি ঘুমিয়ে কতটা বিশ্রাম পেলেন।
যদি আপনি বিছানায় ঘুমানোর জন্য লড়াই না করে সহজেই ঘুমাতে পারেন ও সকালে সতেজ বোধ করেন, তবে এটি ভালো লক্ষণ। কিন্তু ঘুমানোর পরও ক্লান্তি বা ঘুম ঘুম ভাব থাকলে, তা উদ্বেগের বিষয়।
অতিরিক্ত ঘুম নিয়ে করণীয়
-
ঘুম ও জাগরণ নিয়মিতভাবে ট্র্যাক করুন ঘুমের অ্যাপ, ঘড়ি বা হাতে লেখা জার্নাল কাজে আসতে পারে।
-
যদি নয় ঘণ্টার বেশি ঘুম সত্ত্বেও ক্লান্ত থাকেন, দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
-
বিষণ্নতা, ঘুমের ব্যাঘাত, থাইরয়েডের সমস্যা বা পুষ্টিহীনতা সবই এর পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে।
-
ঘুমের মান বাড়াতে:
-
নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ঘুমানো ও ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন
-
রাতে মন শান্ত রাখা ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস এড়িয়ে চলুন
-
রাতের খাবারে হালকা থাকুন এবং ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল পরিহার করুন
-
কেন আমরা অতিরিক্ত ঘুম নিয়ে কম চিন্তা করি?
প্রচলিত আলোচনা সবসময় ঘুম কম হওয়া নিয়ে। ইনসমনিয়া ও ঘুম কমে যাওয়া আজকের বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। কিন্তু আমরা যদি দীর্ঘ ঘুম, ক্লান্তি, ওজন বেড়ে যাওয়া, মেজাজ খারাপ ও ব্যথার মতো উপসর্গগুলিকে উপেক্ষা করি, তবে সমস্যার গভীরতা কখনোই ধরা পড়বে না।
Jahan