ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চিন্তা যেমন, মানসিক অবস্থা তেমন

শেখ ফরিদ

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ৫ জুন ২০২৫

চিন্তা যেমন, মানসিক অবস্থা তেমন

ছবি: মাইনুর রহমান জয়

চিন্তার একটি শক্তি আছে—এটি শুধু কোনো দর্শনের কথা নয়, বাস্তবের কথা। সঠিক চিন্তা যেমন একজন মানুষকে আত্মবিশ্বাসী, শান্ত এবং সুস্থ রাখতে পারে, তেমনি ভুল চিন্তা একজন মানুষকে ধীরে ধীরে নিয়ে যেতে পারে হতাশা, দুশ্চিন্তা, এমনকি ভয়ংকর মানসিক রোগের দিকে। সম্প্রতি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি দীর্ঘ কাউন্সেলিং সেশনে এই কথাগুলো বলেছেন দেশের পরিচিত চিকিৎসক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. রাকিব হাসান।

তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন যেভাবে ভাবছি, যেভাবে মানুষকে নিয়ে বা নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছি, সেসব আমাদের মনের অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই চিন্তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ডিপ্রেশন, হীনমন্যতা বা প্যানিক অ্যাটাকের বীজ।

ভয় নয়, বিশ্বাস দরকার
ডা. রাকিব বলেন, প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে এক ধরনের হঠাৎ তীব্র ভয় বা অস্থিরতা, যার উপসর্গ হতে পারে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, বুকে ধড়ফড়, মাথা ঘোরা, গ্যাসের অনুভূতি, বমি ভাব, বা মৃত্যুভয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এসব শুরু হয় একেবারে ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে। ধরুন, কেউ একটু গ্যাস অনুভব করলেই ভাবতে শুরু করে—এই বুঝি প্যানিক অ্যাটাক শুরু হলো। আর এই ভয়ই তাকে সত্যিকারের প্যানিকের দিকে ঠেলে দেয়।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “গ্যাস থেকে প্যানিক অ্যাটাক হয় না। বরং প্যানিক অ্যাটাক থেকেই গ্যাসের মতো উপসর্গ হয়। চিন্তা ভুল হলেই বিপদ। কিন্তু সঠিক চিন্তা আপনাকে সেই মুহূর্তে রক্ষা করতে পারে।”

চিন্তার বিপদ: অন্যকে নিয়ে ভুল ধারণা
মানুষের সামাজিক চিন্তাও তার মানসিক অবস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। ডা. রাকিব উদাহরণ দেন: “আপনি কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন, সে ব্যস্ত ছিল বলে হয়তো এক মিনিট কথা বলেই চলে গেল। আপনি যদি ভাবেন ‘সে আমাকে পাত্তা দেয় না’, ‘আমি তো আগের মতো কিছুই না’, তাহলে এই নেতিবাচক চিন্তা আপনাকে ডিপ্রেশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি ভাবেন, 'সে হয়তো কাজ নিয়ে ব্যস্ত', তাহলে সেই হতাশা আসবে না।”

তুলনা নয়, নিজের শক্তির স্বীকৃতি জরুরি
নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করাও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক। আমার চেহারা খারাপ, আমি কথা বলতে পারি না, আমি ওদের মতো স্মার্ট না—এই ধরনের চিন্তা আপনাকে অসহায় করে তুলবে। বরং নিজের শক্তি, অর্জন, ভালো গুণগুলো মনে রাখুন, বলছেন বিশেষজ্ঞ। আপনি চাষাবাদ পারেন, ভালো পেইন্ট করতে পারেন, পরিবারের জন্য কাজ করেন—এই শক্তিগুলোকে চিনে নিন।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিন
অনেকেই পরীক্ষা, উপস্থাপনা বা মানুষের সামনে কথা বলার সময় ভয় পান। ডা. রাকিব বলেন, “এই ভয়ও এক ধরনের ভুল চিন্তা। আপনি আগে তো পরীক্ষা দিয়েছেন, প্রেজেন্টেশন করেছেন। তাহলে আজ পারবেন না কেন? আগেও ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু তো পেরেছিলেন। তখন ভয় সত্য ছিল না, এখনো তা নয়।”

অতিরিক্ত চিন্তা নয়, যথাযথ চিন্তা
পরীক্ষার আগে অনেক শিক্ষার্থী একেবারে ভবিষ্যতের অনেক দূরের চিন্তা করে বসে—আমি কীভাবে ডাক্তার হবো, কোথায় ভর্তি হবো। কিন্তু সেই চিন্তা শুধু মানসিক চাপে পরিণত হয়। ডা. রাকিব বলেন, “চিন্তা করুন শুধু সামনের ধাপটা নিয়ে—এইচএসসি পরীক্ষা ঠিকমতো দেওয়া, তার আগে টেস্ট পরীক্ষা ভালোভাবে দেওয়া। এক লাফে তিন ধাপ চিন্তা করলে ওভারথিংকিং হয়ে যাবে। এই বেশি ভাবাই কিন্তু অনেক সময় আপনাকে পিছিয়ে দেয়।”

কাউন্সেলিংয়ের মূল কথা: চিন্তা বদলান, জীবন বদলাবে
শেষে ডা. রাকিব বলেন, সঠিক চিন্তা করলে বিষণ্নতা কমে যায়, সাহস বাড়ে। কাউন্সেলিং মানেই হলো—ভুল চিন্তা ধরিয়ে দেওয়া এবং সঠিক চিন্তা শেখানো। চিন্তা করতে হবে, তবে সেটা হতে হবে যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবভিত্তিক এবং স্বপ্নের পায়ে মাটি রেখে। না বেশি, না একদম কম—পর্যাপ্ত এবং সঠিক চিন্তা মানুষকে মুক্তি দিতে পারে।

এই পরামর্শগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, প্রতিটি মানুষের জন্যই একান্ত জরুরি। ভুল চিন্তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেই শুরু হবে আত্মউন্নয়নের পথ।

ফরিদ 

আরো পড়ুন  

×