ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এভয়েডেন্ট অ্যাটাচমেন্ট: ভালোবাসার ভয় যেভাবে সম্পর্ক ভেঙে দেয়

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৬ জুন ২০২৫

এভয়েডেন্ট অ্যাটাচমেন্ট: ভালোবাসার ভয় যেভাবে সম্পর্ক ভেঙে দেয়

ছবি: সংগৃহীত

একটি সম্পর্ক যখন ধীরে ধীরে গভীরতার দিকে এগিয়ে যায়, তখন সেখানে ভালোবাসার পাশাপাশি দেখা দেয় দায়িত্ব, কমিটমেন্ট এবং পারস্পরিক নির্ভরতার আবহ। কিন্তু কিছু মানুষ রয়েছেন, যাদের কাছে এই ঘনিষ্ঠতা যেন এক অদৃশ্য শ্বাসরোধের মতো। তারা চায় ভালোবাসা, আবার সেই ভালোবাসা থেকেই পালিয়ে যেতে চায়। এমন মানুষদেরকেই বলা হয় "Avoidant Attachment Style"-এ আক্রান্ত ব্যক্তি।

এই ধরণের মানুষদের সম্পর্কে প্রথমেই যা বোঝা দরকার, তা হলো—তারা ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছে, ‘আমার আবেগ আমাকে নিজেকেই সামলাতে হবে’। শৈশবে তাদের কান্না, কষ্ট বা আবেগের জন্য যদি কেউ পাশে এসে না দাঁড়ায়, কোনো মিররিং বা সাড়া না মেলে, তাহলে তাদের ভেতরে জন্ম নেয় একটি বিশ্বাস—এই পৃথিবীতে আমি একা, এবং ভালোবেসে কারো ওপর ভরসা করা যাবে না। এ বিশ্বাস নিয়েই তারা বড় হয়।

বয়ঃসন্ধি পার করে, কর্মজীবনে প্রবেশের পর যখন তারা প্রেমে জড়ায়, তখন দেখা যায় সম্পর্কের প্রথমদিকে তারাও স্বাভাবিক, এমনকি রোমান্টিকও। নানা সারপ্রাইজ, উপহার বা দ্রুত শারীরিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে তারা একটি কমিটমেন্টের আভাস দেয়। কিন্তু বাস্তবে এইসব কৃত্রিম বাহ্যিকতা তাদের নিজেদের ভেতরের ইমোশনাল দূরত্ব ঢাকার চেষ্টা। তারা মুখে কিছু না বলেই বুঝিয়ে দেয়—“আমি আছি, কিন্তু তোমার একেবারে কাছাকাছি নয়।”

সম্পর্ক গভীর হতে থাকলে, যখন বিয়ে, পরিবারের সাথে পরিচয়, ভবিষ্যতের পরিকল্পনার মতো দায়িত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে আসে, তখনই শুরু হয় সংকট। তারা এক পর্যায়ে সেই সম্পর্ক থেকে সরে যেতে শুরু করে—আবেগিক ব্যাখ্যা না দিয়ে, হঠাৎ করে, নিঃশব্দে। তারা হয়ে ওঠে ‘উধাও’ মানুষ—যাদের চলে যাওয়ার পেছনে কোনো ক্লোজার থাকে না।

এ ধরণের মানুষদের পার্টনার তখন এক গভীর মানসিক ট্রমায় পড়েন। তিনি ভাবেন—“এই মানুষটা তো আমার সাথে এত সুন্দর সময় কাটিয়েছে, এত ভালোবাসা দেখিয়েছে, হঠাৎ করে কোথায় গেলো? কেন কিছু না বলেই চলে গেলো?” এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে না।

এ Avoidant Attachment ব্যক্তিরা সম্পর্কের দায় এড়িয়ে যেতে চান, কারণ ঘনিষ্ঠতা তাদের ক্লান্ত করে।
তারা সচেতন বা অচেতনভাবে দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নানা অজুহাত তৈরি করেন—চাকরি, পড়াশোনা, দেশের বাইরে যাওয়া, পারিবারিক চাপ, ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যস্ত কর্মজীবী ব্যক্তি হঠাৎ বলে বসতে পারেন, “আমি খাগড়াছড়িতে জব অফার পেয়েছি, তাই যেতে হবে”—যেখানে বাস্তবে তার ঢাকা শহরেই সেটেলড ক্যারিয়ার ছিল। কিংবা একজন বিদেশে পড়তে যাওয়া পার্টনারের বিপরীতে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন—“তুমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছো, আমি কানাডা যাব।” এতে করে তিনি জেনেবুঝেই একটি দূরত্ব তৈরি করেন।

এই ধরণের ব্যক্তিরা প্রেমে থাকতে চায়, আবার প্রেম থেকে দূরে থাকতে চায়। ফলে সম্পর্ক হয় অসম, বিভ্রান্তিকর এবং একধরনের মানসিক ক্লান্তি সৃষ্টি করে।

এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কী?
নিজের এটাচমেন্ট স্টাইল জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি এমন একজন এভয়েডেন্ট ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে জড়ান, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে, আপনি কোনো "ভাঙা বিশ্বাস"কে ভালোবাসছেন।

থেরাপি ও কাউন্সেলিং এভয়েডেন্ট ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য। তাদের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা ও ভেতরের বিশ্বাস কাঠামো নিয়ে কাজ করতে হয়।

সম্পর্কে স্পষ্টতা ও পারস্পরিক সম্মান জরুরি। কেবল ইমোশন বা ইন্টিমেসি দিয়ে কমিটমেন্ট বোঝা যায় না—সেটা হয় প্রতিনিয়ত চর্চা ও দায়িত্বের মাধ্যমে।


এই প্রতিবেদনটি হয়তো আপনারই গল্প। হয়তো আপনি সেই এভয়েডেন্ট মানুষটি, বা আপনি সেই মানুষটির প্রেমে পড়েছিলেন। যেই হোন না কেন, সম্পর্কে আবেগ ও দায়িত্বের ভারসাম্য না থাকলে, সেটি একসময় একটি নিঃশব্দ ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয়। তাই ভালোবাসুন, বুঝে ভালোবাসুন। সম্পর্ক মানে কেবল ‘থাকা’ নয়, সম্পর্ক মানে ‘থেকে যাওয়া’।

ফরিদ

×