ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ধূমপান না করেও বাড়ছে ফুসফুস ক্যান্সার, কারণ কী?

আহমাদ জামীল হক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা বিভাগ

প্রকাশিত: ২১:৫১, ৬ জুন ২০২৫

ধূমপান না করেও বাড়ছে ফুসফুস ক্যান্সার, কারণ কী?

বিশ্বব্যাপী ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বর্তমানে বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন যাঁরা কখনো ধূমপান করেননি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধূমপানবিহীন ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা দেওয়া ফুসফুস ক্যান্সার মূলত ভিন্ন প্রকারের একটি রোগ, যার কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা।

৫৯ বছর বয়সী মার্থা প্রথম লক্ষ করেন, তার কাশির ধরণ বদলে গেছে এবং শ্বাসনালীর মিউকাস আরও ঘন হয়ে উঠেছে। ডাক্তাররা প্রাথমিকভাবে তার পূর্বনির্ধারিত এক বিরল রোগের ফল মনে করেছিলেন। কিন্তু এক্স-রেতে ফুসফুসে ছায়া ধরা পড়লে শুরু হয় পরীক্ষার পর পরীক্ষা; সিটিস্ক্যান, ব্রঙ্কোস্কোপি ও টিস্যু স্যাম্পল। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে: স্টেজ IIIA ফুসফুস ক্যান্সার।

"একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম," বলেন মার্থা। যদিও তিনি মাঝে মাঝে পার্টিতে সিগারেট ধরাতেন, নিজেকে কখনোই নিয়মিত ধূমপায়ী ভাবতেন না।

ফুসফুস ক্যান্সারই সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার এবং ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ। ২০২২ সালে বিশ্বে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ১৮ লাখ মানুষ মারা যান। যদিও ধূমপান-সম্পর্কিত ক্যান্সার এখনও সংখ্যায় বেশি, তবে ধূমপানহীন রোগীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে ১০-২০ শতাংশ রোগী কখনোই ধূমপান করেননি।

সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল জুরিখ-এর অনকোলজিস্ট আন্দ্রেয়াস উইকি বলেন, "ধূমপান না করা রোগীদের ফুসফুস ক্যান্সার একটি ভিন্ন ধরনের রোগ, যার জিনগত বৈশিষ্ট্য ও চিকিৎসা পদ্ধতি আলাদা।"

এই ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই অ্যাডেনোকারসিনোমা নামের একটি প্রকারে আক্রান্ত হন, যা মূলত শ্লেষ্মা-উৎপাদক কোষে শুরু হয়। সাধারণত এটি ধরা পড়ে অনেক দেরিতে, যখন টিউমার অনেক বড় হয়ে যায় বা ছড়িয়ে পড়ে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা—বিশেষত এশীয় নারীরা—এই ধরনের ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হন। এর পেছনে রয়েছে ইজিএফআর (EGFR) নামে একটি জিন মিউটেশন। অনেক নারীর দেহে হরমোনজনিত কারণে এই মিউটেশন বেশি সক্রিয় থাকে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

 ইজিএফআর (EGFR) মিউটেশনের মতো “ড্রাইভার মিউটেশন” চিহ্নিত হওয়ার পর, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ ওষুধ তৈরি করে যা এই জিনকে অবরুদ্ধ করতে পারে। যদিও প্রাথমিকভাবে ভালো ফলাফল দেখা যায়, পরে অনেক সময় রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে আধুনিক ওষুধ এখন আরও কার্যকর, এবং রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বাড়ছে।

"আগে যেখানে গড় আয়ু ছিল ১২ মাস, এখন তা কয়েক বছর," বলেন উইকি। বহু রোগী ১০ বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং সুস্থভাবে বেঁচে আছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ক্যান্সারের মূল কারণগুলোর একটি হলো বায়ু দূষণ। বিশেষ করে PM2.5 নামে পরিচিত ক্ষুদ্র কণিকা, যা গাড়ির ধোঁয়া ও জ্বালানি থেকে নির্গত হয়, ফুসফুসে গিয়ে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষ সক্রিয় করে তোলে।

লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, PM2.5 সরাসরি DNA-তে মিউটেশন না ঘটালেও, এটি দেহের ম্যাক্রোফেজ নামক প্রতিরক্ষা কোষকে উদ্দীপ্ত করে, যা আবার EGFR মিউটেশন বহনকারী কোষকে জাগিয়ে তোলে।

বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রান্নার জন্য কাঠ, কয়লা বা গ্যাস ব্যবহারে উৎপন্ন ধোঁয়া, রান্নার তেলের বাষ্প—সবই ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। নারীরা বেশি সময় রান্নাঘরে থাকার কারণে তারা বেশি ঝুঁকিতে পড়েন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৯৯% মানুষ এমন এলাকায় বাস করে যেখানে PM2.5 মাত্রা নিরাপদ সীমার অনেক ওপরে। ২০২২ সালে বিশ্বে PM2.5-জনিত প্রায় ১.৯৪ লাখ ফুসফুস ক্যান্সারের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ চীন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো।

ভারত, বিশেষ করে দিল্লিতে, প্রতি ঘনমিটারে গড় PM2.5 মাত্রা ১০০ মাইক্রোগ্রাম ছাড়িয়ে যায়—যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের ২০ গুণ বেশি।

মার্থা এখন EGFR ইনহিবিটর ব্যবহার করছেন। যদিও এতে ক্লান্তি, ত্বকের সমস্যা, ব্যথা ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, তবুও রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, "এই রোগ নিয়ে সমাজে যে আতঙ্ক ও অপরাধবোধ ছিল, তা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে, এটাই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক।"

ফুসফুস ক্যান্সার আর শুধু ধূমপায়ীদের রোগ নয়। দূষিত বাতাস, জিনগত মিউটেশন এবং জীবনযাত্রার নানা দিক এই রোগকে ধীরে ধীরে আরও জটিল করে তুলছে। সচেতনতা ও আগাম সতর্কতাই হতে পারে বাঁচার বড় উপায়।
(বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন হতে পরিমার্জিত এবং অনূদিত)

Jahan

×