
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে এক প্রাণঘাতী ছত্রাক, যা মানবদেহের ফুসফুসে ভয়ংকর সংক্রমণ ঘটাতে পারে। গবেষকরা বলছেন, পৃথিবী এখনো এই নতুন হুমকির জন্য মোটেই প্রস্তুত নয়।
সম্প্রতি ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘Aspergillus’ নামের এক সাধারণ ছত্রাক ভবিষ্যতে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার মতো নতুন অঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ছত্রাকের কারণেই ঘটে ‘অ্যাসপারজিলোসিস’ নামের এক মারাত্মক ফুসফুসের রোগ।
দেহের ভেতরেই বাসা বাঁধে, খেয়ে ফেলে ভিতর থেকে
গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানী নরম্যান ভ্যান রেইন জানান, “যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ব্যর্থ হয়, তখন এই ছত্রাক শরীরের ভেতরে জন্ম নিতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে দেহকে ভিতর থেকে খেতে থাকে।”
‘Aspergillus’ সাধারণত মাটি বা পচা-গলা জৈব পদার্থে জন্ম নেয় এবং বাতাসে কোটি কোটি অদৃশ্য স্পোর ছড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন আমরা শ্বাসের সঙ্গে কিছু স্পোর নিই বটে, তবে অধিকাংশ মানুষের শরীরে তা সংক্রমণ ঘটায় না। তবে যাঁরা হাঁপানি, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ক্যান্সার, অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন, তাঁদের জন্য এই ছত্রাক হতে পারে প্রাণঘাতী।
মৃত্যুহার ২০-৪০ শতাংশ
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাসপারজিলোসিস রোগে মৃত্যুহার ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। এই রোগ সহজে শনাক্তও হয় না, কারণ এর উপসর্গ যেমন জ্বর, কাশি ইত্যাদি অনেক সাধারণ রোগের সঙ্গে মিলে যায়।
আরও ভয়ংকর খবর হলো—এই ছত্রাক বর্তমানে প্রচলিত বহু অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বিশ্বজুড়ে মাত্র চারটি কার্যকর অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ রয়েছে, যেগুলোর কার্যকারিতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
উষ্ণতার কারণে বেড়ে চলেছে বিস্তার
গবেষণায় উঠে এসেছে, Aspergillus flavus নামের ছত্রাক প্রজাতিটি—যা মূলত গরম ও আর্দ্র অঞ্চলে দেখা যায়—ভবিষ্যতে আরও ১৬ শতাংশ বেশি অঞ্চলজুড়ে বিস্তার লাভ করতে পারে। এতে উত্তর আমেরিকা, চীনের উত্তরের প্রদেশ এবং রাশিয়া সরাসরি ঝুঁকিতে পড়বে।
এই ছত্রাক শুধু মানুষ নয়, শস্যও আক্রান্ত করে, ফলে এটি খাদ্যনিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি। ২০২২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ছত্রাক’ হিসেবে ঘোষণা করে।
অন্যদিকে Aspergillus fumigatus, যা সাধারণত ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকে, সেটিও এখন উত্তরমেরুর দিকে ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটাচ্ছে। গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে ইউরোপে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ এই সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বেন।
ছত্রাক বদলে নিচ্ছে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যও
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, শুধু পৃথিবীর উষ্ণতাই নয়, ফাঙ্গাসের ভেতরকার জেনেটিক গঠনও পরিবর্তিত হচ্ছে। তারা এখন মানুষের শরীরের উষ্ণ পরিবেশে টিকে থাকতে শিখে যাচ্ছে, যা এই সংক্রমণকে আরও জটিল করে তুলছে।
জলবায়ু বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যার মতো দুর্যোগগুলিও ছত্রাক ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জপলিন শহরের টর্নেডোর পর ব্যাপক হারে ছত্রাক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল।
চিকিৎসা ব্যবস্থা পিছিয়ে
বিশ্বের বেশিরভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও ছত্রাকজনিত রোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত নয়। সংক্রমণ শনাক্ত করার জন্য যে পরিমাণ গবেষণা ও জনসচেতনতা দরকার, তা অনেক কম। অনেক চিকিৎসক এসব রোগ চিনতেই পারেন না, ফলে রোগী দ্রুত মৃত্যুর মুখে পড়ে।
কাল্পনিক সিরিজ, বাস্তব হুমকি
এই ছত্রাক নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে HBO-র আলোচিত সিরিজ ‘The Last of Us’ এর পর, যেখানে মিউট্যান্ট ফাঙ্গাস আক্রান্ত মানুষ ভয়ঙ্কর দানবে পরিণত হয়। যদিও সিরিজটি কাল্পনিক, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন—বাস্তবেও ছত্রাক মানবজাতির জন্য এক নতুন ও ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, ছত্রাকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখনই প্রস্তুতি না নিলে ভবিষ্যতে এই জীবাণু হয়ে উঠতে পারে পরবর্তী মহামারির কারণ।
সূত্র: সিএনএন।
রাকিব