
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস
১৯৬৯ সালে ড. বারুক স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ এবং তাঁর দল হেপাটাইটিস বি ভাইরাস শনাক্ত করেন। পরবর্তীতে এর রোগনির্ণয় পরীক্ষা উদ্ভাবন এবং টিকা তৈরি করে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর এ আবিষ্কারকে স্মরণ করে ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন অর্থাৎ ২৮ জুলাই বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়।
হেপাটাইটিস বি ও সি-এর কারণে প্রতিবছর ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এ হার এইচআইভি/এইডস এবং ম্যালেরিয়া থেকেও বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ৬ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং প্রায় ১ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। প্রতিবছর অন্তত ২৫ হাজার মানুষ মারা যান এ ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে। বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ লিভার ক্যানসার হয় হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের যে কোনো একটির কারণে। অথচ আক্রান্ত রোগীর প্রতি ১০ জনের ৯ জনই জানেন না যে তারা হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। এ বছর হেপাটাইটিস দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, হেপাটাইটিসের জন্য এক মুহূর্ত অপেক্ষা নয়। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে হেপাটাইটিস পরীক্ষা করুন প্রয়োজনে হেপাটাইটিসের প্রতিষেধক এবং চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
হেপাটাইটিস বলতে লিভারে প্রদাহজনিত জটিলতাকে বোঝায়। ভাইরাল হেপাটাইটিস হলো ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লিভারের প্রদাহ। হেপাটাইটিস ভাইরাস পাঁচ ধরনের, যেমন হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই। হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক। এই দুই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগই লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো শারীরিক সমস্যা বা লক্ষণ অনুভব করেন না। তবে অনেক সময় এক বা একাধিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ:
* জন্ডিসের লক্ষণ প্রকাশ অর্থাৎ চোখের সাদা অংশ এবং পুরো শরীর হলুদ হয়
* কখনো কখনো পেটের ডান পাশের ওপরের দিকে ব্যথা হয় এবং দুর্বলতা বা ক্লান্তিবোধ হয়
* ফ্লু-এর মতো জ্বর বা জ্বর জ্বর ভাব হয়
* বমি বা বমি ভাব কিংবা ক্ষুধামন্দা হতে পারে
* শরীর ও পেশিতে ব্যথা হয়
* শরীরের ত্বকের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায়
হেপাটাইটিস কী ভাবে ছড়ায়
* হেপাটাইটিস এ ও ই মূলত দূষিত খাবার খাওয়া বা দূষিত পানি পানের মাধ৬্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপদ পানির অভাব এবং স্যানিটেশন স্বল্পতার সঙ্গে অভাবযুক্ত দেশগুলোতে প্রায়শই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
* হেপাটাইটিস বি সংক্রামিত ব্যক্তির রক্ত বা শরীরের অন্যান্য তরলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, এটি প্রসবের সময় মা থেকে সন্তানে ছড়িয়ে যেতে পারে অথবা রেজার কিংবা টুথব্রাশ ভাগাভাগির মাধ্যমে, অরক্ষিত যৌন মিলন কিংবা ইনজেকশনের সুচ ও সিরিঞ্জ ভাগাভাগির মাধ্যমেও ছড়িয়ে যায়।
* হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা রেজার বা অরক্ষিত যৌন মিলন কিংবা ইনজেকশনের সুচ ও সিরিঞ্জ ভাগাভাগির মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।
হেপাটাইটিস প্রতিরোধের উপায়
* হেপাটাইটিস এ ও ই সংক্রমণ রুখতে বিশুদ্ধ পানী সরবরাহ, নিরাপদ খাবার, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে হবে।
* রক্তদান ও গ্রহণের পূর্বে রক্তদাতার হেপাটাইটিস-বি ও সি পরীক্ষা করে নিতে হবে।
* একই ইঞ্জেকশনের সুুচ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
* চিকিৎসা বা সার্জারির সময় জীবানুমুক্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
* অন্যের ব্যবহৃত ব্রাশ, শেভিং রেজার, কান বা নাক ছিদ্রকরণের সুচ ব্যবহার করা যাবে না।
* নিরাপদ যৌন চর্চা করতে হবে।
* সকল নবজাতককে জন্মের পরপরই হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন দিতে হবে।
* লিভারের পক্ষে ক্ষতিকারক বস্তু, যেমন অ্যালকোহল বা ধূমপান বর্জন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, হেপাটাইটিস ছোঁয়াচে নয়। হেপাটাইটিস বি ও সি চিকিৎসাযোগ্য এবং চিকিৎসায় অনেকটাই নিরাময়যোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত কার্যকর নতুন নতুন ওষুধ বাজারে সহজলভ্য হওয়ায় চিকিৎসার মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য।
লেখক : পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ, আলোক হেলথকেয়ার লি. মিরপুর ১০, ঢাকা। হটলাইন – ১০৬৭২