ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়েদের শরীরে পুরুষ হরমোন!

ব্রিগে. জে. ডা. আঞ্জুমান আরা বেগম

প্রকাশিত: ০১:২৬, ৬ জুন ২০২৩

মেয়েদের শরীরে পুরুষ হরমোন!

হরমোন সমস্যা যার পূর্ণরূপ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম

পিসিওএস(PCOS)
পিসিওএস কি?
পিসিওএস(PCOS) বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের নারীদের একটি পরিচিত হরমোন সমস্যা যার পূর্ণরূপ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম।  পলি শব্দের অর্থ অনেক এবং পলিসিস্টিক শব্দের অর্থ অনেক সিস্ট। মেয়েদের শরীরে পুরুষ হরমোন অর্থাৎ অ্যান্ড্রোজেনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে ডিম্বাশয়ের আশপাশে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়। ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বড় হয়ে একসময় বের হওয়ার কথা থাকলেও তা আর বের হতে পারছে না, বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। এটিকেই বলা হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা সংক্ষেপে পিসিওএস (চঈঙঝ)
কোন্ বয়সে পিসিওএস বেশি হয়?
সাধারণত ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের এই রোগের প্রবণতা বেশি। গবেষণায় দেখে গেছে, ৪০ শতাংশ নারীই এই বয়সের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। তবে প্রজননক্ষম (১৮-৪৪) যে কোনো বয়সী নারীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ অনেকাংশে পাওয়া যায়।
পিসিওএসে যেসব লক্ষণ ও  উপসর্গ দেখা দিতে পারে:
পিসিওএসে আক্রান্ত নারীদের মাঝে অনেক লক্ষণ দেখা যায়। যেমন-
অনিয়মিত মাসিক বা পিরিয়ডের সমস্যা :
অনেকেরই পরপর বা একাধিকবার পিরিয়ড মিস হয়। যখন পিরিয়ড হয় তখন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি রক্তপাত হয়।
অস্বাভাবিক ওজন বেড়ে যাওয়া: 
এ রোগে আক্রান্ত মেয়েদের ওজন ও বিএমআাই (ইড়ফু সধংং রহফবী পধষপঁষধঃড়ৎ) স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। বিএমআই ২৫-৩০ হলে ওভারওয়েট এবং ৩০ এর বেশি হলে ওবেস বলা হয়। পিসিওএসে আক্রান্ত অন্তত ৫০ শতাংশ নারীই ওবেস বা মোটা।
ব্রণের সমস্যা বেড়ে যাওয়া: 
পিসিওএস থাকলে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বেশি নিঃসরণ হয়।  যার কারণে ত্বকে বেশি তেল উৎপন্ন হওয়ার দরুন তেলতেলে একটা ভাব হয়। এতে করে মুখসহ, পিঠ ও বুকে প্রচুর ছোট ছোট ব্রণ দেখা যায়। অনেক সময় ত্বকের বিভিন্ন জায়গায় পিগমেন্টেশন বা কালো দাগও দেখা যায় বলে অনেক নারীরাই বেশ অস্বস্তিতে পড়ে।
৪.গর্ভধারণে অসুবিধা ও বন্ধ্যত্ব: পিসিওএস থাকলে ডিম্বাণু নিঃসরণ চক্র অনিয়মিত হয় বলে গর্ভধারণে অসুবিধা হয়। যদিও এ রোগে গর্ভধারণ সম্ভব হলেও মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের ঝুঁকি থেকেই যায়।
দেহে অবাঞ্ছিত লোম ওঠা এবং চুলপড়া: 
পুরুষ হরমোন অর্থাৎ অ্যান্ড্রোজেনের উচ্চ মাত্রার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ( যেমন- বুক,পেট,থাই) অতিরিক্ত লোম (হিরসুটিজম) দেখা দেয়। এছাড়াও চুল পড়ার মতো সমস্যা বাড়তে থাকে এবং চুল পাতলা হয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো টাক দেখা দিতে পারে।
এটি কিভাবে নির্ণয় করা যায়?
১.পারিবারিক ইতিহাস বা ফ্যামিলি হিস্ট্রি : 
যেসব মেয়েদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাদের নিকট আত্মীয়ের প্রায় ৫০ শতাংশের এ রোগ পূর্বে হওয়ার সম্পর্ক পাওয়া গেছে। কেননা, এই রোগটি জিনগত। এজন্য পারিবারিক ইতিহাস বা হিস্ট্রি থেকে রোগটা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে ধারণা পাওয়া যায়।
তল পেটের আল্ট্রাসাউন্ড (টঝএ ড়ভ ষড়বিৎ ধনফড়সবহ) :
এই পরীক্ষায় ওভারির আয়তন, ওভারিতে ছোট সিস্টের মতো কতটি সিস্ট আছে ও অন্য  কিছু বিষয় দেখা হয়।
রক্তপরীক্ষা : 
এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজ ও ইনসুলিনের মাত্রা, লিপিড প্রোফাইল ও অন্যান্য হরমোন যেমন : থাইরয়েড, কর্টিসল, প্রোল্যাক্টিনের মাত্রা কেমন আছে তা জানা যায়।
পিসিওএসের চিকিৎসা কি কি?:
পিসিওএসের চিকিৎসা রোগীর লক্ষণ, চিকিৎসা ইতিহাস এবং রোগীর অন্যান্য স্বাস্থ্য অবস্থার ওপর ভিত্তি করে করা হয়। চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে :
১.হরমোনজনিত জন্মনিরোধক : জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জন্মনিরোধক বড়ি, যোনি রিং, প্যাঁচ বা ডিভাইস (ওটউ) ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি একই সঙ্গে মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ, ব্রণ থেকে মুক্তি ও চুলের সমস্যায় ব্যাপক কার্যকর।
২.অ্যান্ড্রোজেন ব্লক ওষুধ: কিছু ওষুধ অ্যান্ড্রোজেনের প্রভাবকে ব্লক করতে সাহায্য করে। এতে করে মাসিক চক্র স্বাভাবিক হয়, অবাঞ্ছিত লোম ও ব্রণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৩. ইনসুলিন সংবেদনশীল ওষুধ: ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় মেটফরমিন (গবঃভড়ৎসরহ) ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি একই সাথে ইনসুলিন তৈরীর পাশাপাশি ইনসুলিনের মাএা নিয়ন্ত্রণ ও পিসিওএসে আক্রান্ত মহিলাদের মাসিক চক্র উন্নতিতে সাহায্য করে।
৪.ওভুলেশন ইন্ডাকশন বা ডিম ফুটতে সাহায্যকারী ওষুধ:
যেসব মহিলারা ভবিষ্যতে গর্ভধারনের পরিকল্পনা করছে,তাদের ডিম্বাশয় থেকে ডিম নি:সরণ প্ররোচিত করার জন্য লেট্রোজোল (খবঃৎড়ুড়ষব), ক্লোমিফেন (ঈষড়সরঢ়যবহব) জাতীয় ওষুধ মুখে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। অনেকক্ষেত্রে, গোনাডোট্রপিন ইনজেকশনের মাধ্যমে এই চিকিৎসা করা হয়ে থাকে।
৫.জীবনযাত্রার পরিবর্তন : স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ওজন কমানো ও ব্যায়াম পিসিওএস রোগীদের এ সমস্যা সমাধানে বহুলাংশে সাহায্য করে থাকে।
৬.সার্জারি: আধুনিক চিকিৎসায় সিস্টের আকার বা সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলে ল্যাপারোস্কোপিক ওভারিয়ান ড্রিলিং (খঙউ) পদ্ধতির সাহায্যে খুব সহজেই সিস্টের অপারেশন করা হয়ে থাকে।
কী ভাবে পিসিওএস প্রতিরোধ করবেন?
১.স্বাস্থ্যকর ডায়েট: সবুজ শাকসবজি বা ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার প্রোটিনের পাশাপাশি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ডায়েট কন্ট্রোলে না আসলে প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হয়ে এ সমস্যার সমাধান করুন।
২.নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস: যেহেতু অতিরিক্ত ওজন পিসিওএসের সম্ভাবনা বাড়াতে অনেকাংশে দায়ী। এজন্য শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমাতে প্রজননক্ষম নারীদের ব্যাপক উৎসাহী হতে হবে।
৩.পিসিওএসের ঝুঁকি সৃষ্টিকারী রোগসমূহের নিয়ন্ত্রণ : কারোর ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপদ্ধতি ও পরামর্শ অনুসরণ করলে পিসিওএসের সমস্যা রোধে ভবিষ্যতে ব্যাপক খরংঃবহরহম ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান 
স্ত্রীরোগ, প্রসূতীবিদ্যা ও বন্ধ্যত্ব রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন
আলোক হেলথ কেয়ার লি.
মিরপুর, ঢাকা -১০

×