
সোমেশ্বরী নদী
সোমেশ্বরী নদী পূর্বে ছিল অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য লীলাভূমি। কিন্তু বর্তমানে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ধ্বংসের মুখে এ নদী। প্রতিদিন প্রায় ৪১ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে এ নদী থেকে। নদীর বিভিন্ন জায়গায় শত শত ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়ে থাকে। উত্তোলনকৃত ভেজা বালু দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরবরাহ করা হয়।
প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার পরিবহন ট্রাক এ বালু উত্তোলন করে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত ওজন ও ভেজা বালু পরিবহনের ফলে ভেঙে গেছে ৩১৬ কোটি টাকায় নির্মিত শ্যামগঞ্জ বিরিশিরি সড়ক। ফলে সড়ক দূর্ঘটনা এখানের নিত্য দিনের ঘটনা। এপর্যন্ত অসংখ্য পথযাত্রী এবং স্কুল শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝড়েছে এ মহাসড়কে।
গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে সোমেশ্বরী নদী। নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা দিয়ে। দুর্গাপুর থেকে জারিয়া, বাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে কংস নদে। স্থানীয় জেলেদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল সোমেশ্বরীতে মাছ ধরা। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক পর্যটক আসত। পর্যটনও আয়ের একটি অন্যতম উৎস ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের।
সোমবার সোমেশ্বরী নদী সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, নদীটির বিভিন্ন জায়গায় শত শত বসানো ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমান বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর মধ্য দিয়ে রাস্তা করে বিভিন্ন পরিবহন ট্রাকে করে তা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাহাড় থেকে নেমে আসায় সোমেশ্বরীর খরস্রোত বহু শতবর্ষ ধরে বয়ে আনত বালু আর নুড়িপাথর। সোমেশ্বরী নদীকে একসময় বলা হতো এ অঞ্চলের মানুষের জন্য আর্শীবাদ। কিন্তু এই বালু আর পাথরই নদীটির কাল হলো অবশেষে।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সোমেশ্বরী এখন আর নদী নেই, হয়ে গেছে এক জলধারা। প্রতিদিন নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় নদীটি এখন সংকুচিত ও ক্ষতবিক্ষত। এতকাল দখল, দূষণ-এসব শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল নানা নদীর নাম। কিন্তু পাহাড়ি খরস্রোতা সোমেশ্বরীর বর্তমান দশা দেখে মনে হয় শুধু দখল-দূষণ নয়, দুর্বিনীত তান্ডব চলছে তার বুকে।
জানা যায়, ইজারা নিয়ে নদী থেকে বালু তুলছে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই। কিন্তু মানা হচ্ছে না ইজারার শর্ত। এককালের চোখ জুড়ানো এই নদী রক্ষায় কারও কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেই। শত শত (ড্রেজার) কান ফাটানো বিকট শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে নদীর দুই পাশের প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার এলাকায়।
দূষিত পরিবেশ। দুর্বিষহ পরিস্থিতি। ক্ষতবিক্ষত সোমেশ্বরীর পাড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে কানে প্রায় তালা লেগে যায়। নদীর বুক খুঁড়ে প্রতিদিন তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার ট্রাক বালু, নুড়ি পাথর আর কয়লা। নদী থেকে যেসব যন্ত্র দিয়ে এবং যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে, তা দন্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের তৎপরতায় যারা যুক্ত আছেন, তাদের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে সোমেশ্বরীর পাড় একসময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সৌন্দর্যপিপাসু উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত, তার পাড়ে এখন দেখা মিলে বালু উত্তোলনকারী শত শত শ্রমিক। সোমেশ্বরীর ইজারা দেওয়া পাঁচটি বালুমহালের আয়তন প্রায় দুই হাজার একর। নদীর প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা গেছে বালু পরিবহন ও বালু তুলা হচ্ছে। এই অপতৎপরতা বন্ধ না করলে মরে যাবে নদীটি। এলাকার তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশ ভারসাম্য হারাবে। সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুসং-দুর্গাপুর সোমেশ্বরী কংস ছাড়া শ্রীহীন হয়ে যাবে।
সোমেশ্বরী নদীর বালুমহাল ইজারার শর্তাবলিতে বলা হয়েছিল, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা অনুসারে পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন করা যাবে না। বলা হয়েছিল, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য, জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বালু উত্তোলন করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইজারাদারেরা এসব শর্তের কিছুই মানছেন না। তিনটি বালুমহালের পাঁচ কিলোমিটার নদীর অংশে দিনরাত হাজারখানেক নিষিদ্ধ ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বালুর সঙ্গে দেদার উঠছে পাথর ও কয়লা। বালুখেকোরা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে সড়ক, সেতু ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধকে।
স্থানীয় জনগনের কাছ থেকে জানা যায়, দিন রাত সবসময় ই এখন নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে যে শুধু নদীর ক্ষতি হচ্ছে তা নয় ট্রাক এবং ড্রেজারের উচ্চ শব্দে বহু মানুষের শ্রবনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বলা যেতে পারে সোমেম্বরীর পাশের মানুষেরা বোবা কালা হয়ে এক অমানবিক পরিবেশে জীবনধারন করছেন।
বালুমহালের ইজারাদাররা বলেন, আমরা সরকারি নিয়ম মেনেই বালুমহাল চালাচ্ছি। প্রতিদিন নিয়ম মেনেই বালু উত্তোলন করা হয়। তবে একটু বেশি পরিমান বালু তোলা হয় কারন এ বালুর চাহিদা অনেক বেশি। দেশের সব প্রান্তেই আমাদের এ বালু পরিবহন করা হয়। তবে নদীর ক্ষতি হোক তা আমরা কেউ চাইনা।
এস