
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি রাজধানীর ডেমরা এলাকায় পরকীয়া, ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেইলের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে, যা সমাজে এক গভীর উদ্বেগ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের পেছনে তরুণদের মধ্যে দিন দিন বেড়ে যাওয়া পর্নোগ্রাফি আসক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সমাজব্যবস্থায় এই ধরণের সংকট কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, বরং পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রয়োজনীয় মনিটরিং, জনসচেতনতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রের তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে ডেমরায় একাধিক ধর্ষণ, অপহরণ ও ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা ঘটেছে, যা এলাকাবাসীর মধ্যে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
গত কিছু সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা হলো- ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইউসুফ (২৪) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয় এক গৃহবধূর পর্নোগ্রাফিক ভিডিও ছড়িয়ে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে। একই বছরের ২২ নভেম্বর দেলোয়ার হোসেন (৪৬) নামের এক ব্যক্তি তার সাড়ে ৬ বছর বয়সী ভাতিজিকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক হয়। ২০২৪ সালের ৭ জুন ১৭ বছর বয়সী এক তরুণীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ ও গর্ভবতী করার অভিযোগে ইমাদুল ইসলাম সিয়াম (২১) গ্রেফতার হয়, এবং ১৯ জুন বড় ভাই দানিয়েল শাহজালাল (২১) তার ১৯ বছর বয়সী বোনকে একাধিকবার ধর্ষণ করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া ১৩ জুলাই মো. তোয়াফেল (২৬) নামের এক ব্যক্তি ১৬ বছর বয়সী মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক হয়। ২০২৫ সালের ২ মার্চ হাবিবুর রহমান (২২) প্রবাসীর স্ত্রীর ছোট বোনের নগ্ন ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইলের পর বড় বোনকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হয়। একই ধারাবাহিকতায় ৪ মার্চ সাব্বির খাঁন শাওন (২৭) প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ ও ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে গ্রেফতার হয়। ১৯ মার্চ স্ত্রী পরকীয়ায় অন্যত্র চলে যাওয়ার ৪ মাস পর সন্তান আনতে গিয়ে সজল গুরুতর আহত হলে স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের। ৯ এপ্রিল মানসিকভাবে অসুস্থ এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় শাহেদ আফ্রিদি ও মাহাদীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর ১৫ এপ্রিল মো. আব্দুল মতিন এক কলেজছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার হয় এবং ২২ এপ্রিল মেহেদী হাসান শান্ত ও আব্দুল্লাহ আল মাহিম নামের দুই যুবক এক তরুণীর ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও পর্নোগ্রাফি সাইটে ছড়িয়ে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে গ্রেফতার হয়। সর্বশেষ, ২ মে উজ্জল চন্দ্র দেব (২৬) এক গৃহবধূকে অপহরণের অভিযোগে এবং ৩ মে কলেজছাত্রীকে ইভটিজিংয়ের অভিযোগে রোমান সিকদার (২০) ও শুভ হাওলাদার (২০) কে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনাগুলো ডেমরায় অপরাধের ভয়াবহতা এবং ক্রমবর্ধমান হারের উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে। যদিও পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবুও এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।
ডেমরার সচেতন মহল মনে করেন, প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের জীবন যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি এর অপব্যবহার তরুণ সমাজে সৃষ্টি করছে গভীর অস্থিরতা। বিশেষ করে ডেমরায় কিশোর-তরুণদের মধ্যে এই সমস্যার বিস্তার দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। পারিবারিক পর্যবেক্ষণের অভাব এবং সামাজিক অনুশাসনের দুর্বলতার ফলে তারা ক্রমেই ভার্চুয়াল জগতে আশ্রয় নিচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠছে তাদের নতুন ঠিকানা। তারপর তারা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে এক কল্পনার অবাস্তব জগতে, যার কেন্দ্রে রয়েছে পর্নোগ্রাফি। এই আসক্তি অনেককে ঠেলে দিচ্ছে বিকৃত মানসিকতায়। এর প্রভাব পড়ছে পারিবারিক জীবনে-বাড়ছে পরকীয়া, ভেঙে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন। ঘটছে ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং ব্ল্যাকমেইলের মতো ভয়াবহ অপরাধ।
বিজ্ঞান বলছে, পর্নোগ্রাফি মানব মস্তিষ্কে নিউরোকেমিক্যাল প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এক ধরনের 'বিহেভিয়োরাল অ্যাডিকশন' সৃষ্টি করে, যা মাদকাসক্তির মতোই ক্ষতিকর। পর্ন দেখার সময় মস্তিষ্কে ডোপামিন, অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ও অ্যাড্রেনালিন একসঙ্গে কাজ করে এক ধরনের কৃত্রিম আনন্দ বা তৃপ্তি তৈরি করে। এই সম্মিলিত প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় "নিউরোককটেল ইফেক্ট"। এর ফলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে এই উত্তেজনার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে সাধারণ আনন্দে তৃপ্তি আসে না, এবং কিশোর-তরুণরা আরও উত্তেজক কনটেন্টের খোঁজে নৈতিক সীমা অতিক্রম করে।
গুগল ট্রেন্ডসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে “পর্ন” শব্দটি সবচেয়ে বেশি সার্চ হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। দেশে প্রায় ৯ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রতি মাসে ২-৩ কোটির মতো ভিজিটর পর্নসাইটে প্রবেশ করে। ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২.৯শতাংশ এবং তরুণদের মধ্যে ৮১.৭শতাংশ পর্নোগ্রাফি দেখে থাকে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য-৯-১৩ বছর বয়সেই অনেক শিশু প্রথমবারের মতো পর্নোগ্রাফির সংস্পর্শে আসে। ছেলে শিশুদের মধ্যে এই হার ৯৩শতাংশ, মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে ৬২শতাংশ।
বাংলাদেশ সরকার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা বাস্তবভাবে খুব একটা কার্যকর হয়নি। ২০১০ সালে ৮৪টি, ২০১৬ সালে ৫৬০টি এবং ২০১৯ সালে প্রায় ২০,০০০ সাইট বন্ধ করা হয়, এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের মার্চে সব নিষিদ্ধ সাইট স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এসব পদক্ষেপ কার্যকারিতা হারিয়েছে। কারণ ব্যবহারকারীরা সহজেই ভিপিএন ও প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমে নিষিদ্ধ সাইটে প্রবেশ করতে পারে। ভিপিএন সার্ভারের আইপি বারবার পরিবর্তন হওয়া এবং ট্রাফিক এনক্রিপ্ট করার ফলে এসব অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও ডিপ প্যাকেট ইনস্পেকশন (ডিপিআই) প্রযুক্তি দিয়ে নির্দিষ্ট কনটেন্ট শনাক্ত করে ব্লক করার ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও এনক্রিপ্টেড ভিপিএনের ক্ষেত্রে সেটিও কার্যকর হয় না।
এই প্রসঙ্গে কম্পিউটার প্রকৌশলী মো. আকরাম হোসেন বলেন, “ভিপিএন নিয়ন্ত্রণে মোবাইল অপারেটর ও আইএসপিগুলোর নেটওয়ার্কে উন্নত ফিল্টারিং প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি ঘরোয়া পর্যায়ে অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা জরুরি। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল, অ্যাপ স্টোর ও অ্যাপ ইনস্টলেশনে পাসওয়ার্ড এবং কম্পিউটার খোলামেলা জায়গায় রাখতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে নিয়মিত আলোচনার করলে কিশোরদের সচেতন করে গড়ে তোলা সম্ভব।”
ডেমরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, “বর্তমানে অনেক তরুণ ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অপরাধ প্রতিরোধে আমরা বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছি এবং যেখানেই অপরাধ ঘটছে, সেখানেই তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি-অপরাধীদের গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা হচ্ছে।” তবে তিনি মনে করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় শুধু পুলিশের তৎপরতা যথেষ্ট নয়; পরিবার এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সচেতন হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক মো. মাসুদ করিম বলেন, “বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা দ্রুতগতিতে পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করছে। তবে প্রযুক্তির এই অবারিত প্রবাহে তারা অনেক সময় ভালো-মন্দের বিচার করার পূর্বেই বিভিন্ন ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক কনটেন্টের মুখোমুখি হচ্ছে। এ অবস্থায় অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো-শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারের নৈতিকতা শেখানো এবং এসব বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে খোলামেলা ও নিয়মিত আলোচনা করা।”
একই ধরণের উদ্বেগ প্রকাশ করে দারুল ইরফান মাদ্রাসার শিক্ষক মো. নূর হোসেন বলেন, “ধর্মীয় শিক্ষা ও আত্মিক গঠনের অভাবে আজকের অনেক কিশোর সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।”
ডিজিটাল আসক্তি এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি এক সামাজিক মহামারি। ডেমরার মতো এলাকায় এই সমস্যা শুধু নৈতিক অবক্ষয়ই নয়, এক ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই তরুণরাই একদিন জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেবে। তাই এখনই প্রয়োজন তাদের রক্ষা করা-তাদের মন, দৃষ্টি, সময় এবং চরিত্রকে একটি নিরাপদ ও নির্মল পথে ফিরিয়ে আনা।
মিরাজ খান