ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সিপিআরডির গবেষণা ফলাফল প্রকাশ

মোংলায় ৮০ এবং শ্যামনগরে ৭০ শতাংশ পরিবার স্থানান্তরণের সংঙ্কায়

প্রকাশিত: ২০:২১, ৯ মার্চ ২০২৩

মোংলায় ৮০ এবং শ্যামনগরে ৭০ শতাংশ পরিবার স্থানান্তরণের সংঙ্কায়

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সম্মানিত চেয়াম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মোংলায় ৮০ শতাংশ এবং শ্যামনগরে ৭০ শতাংশ পরিবার স্থানান্তরণের সংঙ্কায় রয়েছেন। বৃহষ্পতিবার (৯ মার্চ) রাজধানী ঢাকার গুলশানে অবস্থিত বেঙ্গল ব্লুবেরি হোটেলের সম্বর্ধনা হলে সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)’র উদ্যোগে এবং ব্র্যাড ফর দি ওয়ার্ল্ড, ডিয়াকোনিয়া ও এইচইকেএস/ইপিইআর এর সহযোগিতায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের বিপদাপন্নতা অনুসন্ধানে পরিচালিত গবেষণা ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 

গবেষণা ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিআরডি’র নির্বাহী প্রধান মো. শামছুদ্দোহা, প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে আলোচনা করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সম্মানিত চেয়াম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ, বিশেষ অথিতি হিসেবে উপস্থিত থেকে আলোচনা করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ইউএনডিপির সহাকরি আবাসিক প্রতিনিধি মিস্টার প্রসেনজিৎ চাকমা, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর ডিন, প্রফেসর ড. সাবিনা ফায়েজ রশীদ। 

সভায় আলোচনা করেন দিলরুবা হায়দার, প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, ইউএন উইমেন, মাহফুজা আক্তার মালা, জিবিভি এক্সপার্ট, খোদেজা সুলতানা লোপা, কান্ট্রি ম্যানেজার দিয়াকোনিয়া, গওহার নঈম ওয়ারা সদস্য সচিব, ডিএফ, ধারা চৌধুরী কান্ট্রি ডিরেক্টর, এইচইকেএস/ইপিআ, সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের প্রতিনিধি শিরিন লীরা। 

সভায় গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন সিপিআরডির প্রজেক্ট সমন্বয়ক মো. আকিব জাবেদ এবং রিসার্চ এ্যান্ড এ্যাডভোকেসি অফিসার নাজনীন সুলতানা। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্র্মকতা কর্মচারীরা উপস্থিত থেকে মতামত ব্যক্ত করেন।

সিপিআরডি’র পরিচালিত গবেষণাটি থেকে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বিশেষ করে নারীদের বিভিন্ন বিপদাপন্নতার চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা গেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিশাঞ্চলে পানীয় জলের অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যার মধ্যে প্রতিবেশি কর্তৃক খারাপ ব্যবহার (মোংলা অঞ্চলে ৫৭.৮% এবং শ্যামনগর অঞ্চলে ৭৬%), ইভটিজিং (উভয় এলাকায় ১০%), শারীরিক ভাবে আহত হওয়া (দুই উপজেলায়ই ৭০% এর সমান্য কম) উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ সময় ধরে লবণাক্ততার সংস্পর্শে আছেন বা ছিলেন এমন নারীদের প্রায় সবাই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বলে উঠে এসেছে। 

এ নারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন (৬৪% মোংলায় এবং ৫৪% শ্যামনগরে) এবং এরই মধ্যে অনেকেই তাদের জরায়ু, গর্ভাশয় ও গর্ভনালীর মতন প্রজনন অঙ্গ অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পানির সমস্যা, স্যানিটেশনের সমস্যায় (টয়লেট, স্যানিটারি ন্যাপকিন) ভুগে থাকেন মোংলায় ৪১% নারী এবং শ্যামনগরে ৩১% নারী এবং এর ফলে অনেক নারী আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে মাসিক ঋতু-চক্রের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জটিলতায়ও ভুগেছেন। 

শ্যামনগর এবং মোংলা অঞ্চলের ৯০% নারী জীবনে অন্তত একবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের গৃহ হারিয়েছেন অথবা ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছেন। বর্তমানে মোংলার ৮০% পরিবার এবং শ্যামনগরের ৭০% পরিবার স্থানান্তরণের সংঙ্কায় রয়েছেন। মোংলা অঞ্চলের ৯২.৩% অংশগ্রহণকারী এবং শ্যামনগর অঞ্চলের ৯৪% অংশগ্রহণকারী বলেছেন তাদের অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেই স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের হার আশঙ্কাজনক, মোংলায় ৫৬.৬% পরিবারের শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে এবং শ্যামনগরে সেটি ৭২.৮%। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এসকল নারীরা সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা নিতে হলে স্থানীয় প্রভাবশালীদের টাকা প্রদান করতে বাধ্য হন। মাঠ পর্যায়ে নারীদের কর্তৃক এক থেকে পাঁচ হাজার (১,০০০-৫,০০০) টাকা পর্যন্ত স্থানীয় প্রভাবশালীদের দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে গবেষণাটিতে।

 গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায়। একটি মিশ্র গবেষণা পদ্ধতি (প্রশ্নপত্র সমীক্ষা, এফজিডি, কেইস এবং সেকেন্ডারি ডাটা) ব্যবহার করা হয়েছে গবেষণাটিতে। এর মধ্যে ২৬০ টি প্রশ্নপত্র সমীক্ষা (১৪৩টি মোংলায় এবং ১১৭টি শ্যামনগরে), ১৫টি এফজিডি করা হয়েছে যার প্রতিটিতে ১৪ থেকে ১৮ জন উপস্থিত ছিলেন (৫টি মোংলায় এবং ১০টি শ্যামনগরে) এবং ১৭টি কেইস সংগ্রহ করা হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সম্মানিত চেয়াম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ বলেন সিপিআরডি চমৎকার একটি বিষয়ের উপর গবেষণা করেছেন। এ বিষয়টি সবার বুঝতে পারা অনেক সময় কঠিন হয় সিপিআরডি এটিকে বুঝতে সহজ করে দিয়েছে। এ গবেষণা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিভাবে প্রবেশ করছে সেটি উন্মোচন করেছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে বিভিন্ন সংকট তৈরি হচ্ছে কিন্তু এখন আমাদের যেটি জরুরি দেশের বিপদাপন্ন গোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের বিপদাপন্নতা কতটুকু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হচ্ছে সেটি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। নিম্নবিত্ত এবং বিপদাপন্ন মানুষের অধিকার ব্যাপক ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে যেটি গবেষণার মাধ্য যুক্তিযুক্তভাবে আমাদের তুলে ধরতে হবে। 

তিনি আরও বলেন আমাদের উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ সকল কর্মকান্ডে এসডিজিকে বিবেচনায় রেখে পরিচালনা করতে হবে। যদি এসডিজির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানবাধিকারের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব হবে। তিনি বক্তব্যের শেষে বলেন দুর্যোগগুলো কখনোই ভীতিকর হয়ে উঠবেনা যদি আমরা দুর্যোগের অভিঘাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারি এবং দুর্যোগ ব্যপস্থাপনাকে মজবুত করতে পারি।

সভাপতির বক্তব্যে মো: শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বহুমাত্রিক এবং বর্তমানে মানুষের জীবনের বিভিন্ন স্তর জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক প্রভাবে বিপর্যস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কোন ব্যক্তির উপর কেমন প্রভাব ফেলবে সেটি নির্ভর করে তার আর্থিক সক্ষমতা, লিঙ্গ পরিচয়, জাতিগত পরিচয়, বর্ণ পরিচয়, ভৌগলিক অবস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর। 

এই প্রভাবক গুলোর মধ্যে ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শারীরিক সক্ষমতা, পোশাক পরিচ্ছদের শৃঙ্খল এবং বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ আরোপিত হয় ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয়কে ভিত্তি করেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়-ক্ষতি বাংলাদেশে লিঙ্গ বৈষম্যকে আরও বেশি বাড়িয়ে নারীদের বিপদের সম্মুখীন করছে। তিনি আরও বলেন, অভিযোজন বা প্রশমন কোন পরিকল্পনাই যথাযথ ভাবে কাজ করবেনা যদি না লিঙ্গ পরিচয়সহ বিভিন্ন পরিচয়গত ভিন্নতার কারণে বিপদাপন্নতার ভিন্নতাগুলোকে উন্মোচন এবং বিষয়টিতে যথাযথ ভাবে আলোকপাত করা না হয়।

শাহীন আনাম শুরুতেই সিপিআরডি’কে ধন্যবাদ জানান গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টিতে গবেষণা পরিচালনা করার জন্য। তিনি বলেন জলবায়ু পরিবর্তন দেশের সর্বত্র নারীদের বিপদাপন্ন করে তুলছে। নারীদের অধিকার যে ভাবে লঙ্ঘিত হ”ে এটি ছ আগামী দিনে বড় জাতীয় বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। গবেষণায় এবং নীতি প্রণয়নে এই বিষয়গুলোকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
 

রহিম শেখ

×