ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

‘কৌতূহলী শিক্ষার্থীদের উত্তর খোঁজা জরুরি

প্রকাশিত: ১৯:০৩, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

‘কৌতূহলী শিক্ষার্থীদের উত্তর খোঁজা জরুরি

’২০২৪ সালের ডায়ানা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী ছিল? এটি কীভাবে আপনার কাজের প্রতি মূল্যায়ন হিসেবে কাজ করছে?
প্রথম যখন শুনি আমি ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, ভেবেছিলাম হয়ত মশকরা করা হচ্ছে। ডায়ানা অ্যাওয়ার্ডের জন্য নিজে থেকে আবেদন করা যায় না। আমাকে নমিনেট করেছিলেন ‘রিফ্লেক্টিভ টিনস’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ইউসুফ মুন্না ভাই, যিনি শিশু-কিশোরদের সৃজনশীলতা নিয়ে কাজ করেন। আসলে আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, যেখানে একটা শিশুর কৌতুহলের কুঁড়ি ফোটার আগেই তা উপড়ে ফেলা হয়। যার ফলে এ দেশে নোবেল পাওয়ার মতো গবেষক তৈরি হয় না। বিজ্ঞানপ্রিয় এই কৌতুহল শক্তভাবে ধরে রাখার একটা টুল। আমরা এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যে দেশের মাটিতে একদিন কোয়ান্টাম স্কেলের মাইক্রোপ্রসেসর থেকে পেল্লায় মহাকাশযান নিজস্ব গবেষণায় তৈরি হবে। ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও মজবুত করে।

‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ প্রতিষ্ঠার পর আপনি কিভাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার জগতকে নতুন দিশা দিতে সক্ষম হয়েছেন?
২০১৮ সালে আমি একটা গবেষণা খুঁজে পাই। প্রকাশিত হয়েছিল আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স জার্নালে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী তাত্ত্বিক বিজ্ঞান থেকে সরে পড়েন। এর প্রধান কারণ সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের কৌতুহল মেটাতে না পারা। আমি নিজেও এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। এই উদ্বেগ থেকেই বিজ্ঞানপ্রিয়র যাত্রা শুরু। শুরুতে একটা ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করি। যেখানে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করি। শুধু তাই নয়, এই কৌতুহলী শিক্ষার্থীরা নিজেরাই গবেষণাপত্র ঘেঁটে অন্যের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিত। এইভাবে ‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ অনলাইনে বিজ্ঞানের এক আলাদা জগৎ তৈরি করে। আমরা ক্যাম্পেইনগুলো সফলতা বুঝতে পারি, যখন এক বছরে আমাদের কাছে প্রায় আড়াই লাখ প্রশ্ন আসে। আমরা কোনো প্রশ্নই এড়িয়ে যাইনি।

‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ বিশ্বব্যাপী ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর সাফল্যের পেছনে আপনার কী কী মূল উদ্যোগ ছিল?
প্রথমত, ‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ অনলাইনে একটা ভিন্নধর্মী সংস্কৃতি তৈরি করেছে। একটা বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতি, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই প্রশ্ন করে, নিজেরাই উত্তর খুঁজে বের করে। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক কনটেন্ট এবং ভিডিয়ো তথ্যচিত্র। দেশ বিদেশের নানা গবেষণাকে আমরা খুব সহজ ও সাবলীলভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরি আমরা। ‘মানবজীবনের সূচনা’ শিরোনামে আমাদের একটি তথ্যচিত্র দেশব্যাপী প্রায় ২ কোটি মানুষ দেখেছেন।

‘প্রাচি’ প্রকল্পের মাধ্যমে আপনি কীভাবে কমিউনিটিকে আরও নিরাপদ ও সচেতন করতে চান? এই প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রাচি ‘প্রাথমিক চিকিৎসা’র সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সহশিক্ষা কার্যক্রম। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার পরিবারের অন্তত একজন সদস্যকে আমরা প্রাথমিক চিকিৎসায় দক্ষ করে তুলতে চাই। গত বছরই প্রাচির কার্যক্রম শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহায়তায় প্রায় দু’শো শিক্ষার্থীকে ১৮ ঘন্টার প্রশিক্ষণ দিই। এরপর ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (ভিআর) সেট ব্যবহার করে তাদের মানসিক প্রস্তুতি যাচাই করা হয়।

ডায়ানা পুরস্কার পাওয়ার পর, আপনি ভবিষ্যতে কীভাবে আপনার কাজ আরও বিস্তৃত করবেন এবং বিজ্ঞান শিক্ষায় নতুন উদ্যোগ আনবেন?
ডায়ানা পুরস্কার আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক একটি প্রাপ্তি। এটি কেবল একটি পুরস্কারই নয়, বরং ইতোমধ্যে যে পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি, তার অনন্য স্বীকৃতি। পথটা যেহেতু সঠিক, তখন গতি বাড়ানোটাই হবে প্রথম দায়িত্ব। আমরা বাংলা ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো বিজ্ঞানের নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরিকল্পনা করছি। উদ্দেশ্য, দেশ-বিদেশে কর্মরত বাঙালী গবেষকদের সাথে প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের সংযোগ সেতু তৈরি করা। দেশের মেধাবী দেশেই থাকবেÑ এই প্রত্যাশা বাস্তবায়নে দেশে প্রচুর গবেষণাকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান খাত তৈরি করার বিকল্প নেই। যার মূল স্তম্ভ হতে পারে এই পরিকল্পনা।

‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ ২৫,০০০টি ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্ট ও ৩৫০টি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে। শিক্ষার্থীরা কীভাবে এই কনটেন্টগুলি থেকে উপকৃত হচ্ছে?
গবেষণাপত্র জটিল ও দুর্বোধ্য। ফলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী দূরের কথা শিক্ষকেরাও গবেষণাপত্র খুলে দেখেন না। যে হারে বিজ্ঞান এগোচ্ছে, তার সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি না হলে একদিন হয়তো আর থৈ পাব না। আজকের বিজ্ঞান যখন কালকের প্রযুক্তি হয়ে আসবে, আকাশ থেকে পড়ব। বিজ্ঞানপ্রিয়’র উদ্দেশ্য সেই দুর্বোধ্য বিজ্ঞানকে সহজভাবে তুলে ধরা। ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ বেড়ে চলেছে, সেইসাথে একটা অপূর্ব এক ‘ফিউচার-রেডি’ প্রজন্ম গড়ে উঠছে।

×