
ছবি: জনকণ্ঠ
মাহাদী ইব্রাহিম—একজন তরুণ, যাঁর স্বপ্ন কেবল নিজের নয়, দেশের তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা হওয়ার। একজন এনসিটিবি বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী হয়েও যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার পেয়ে অর্জন করেছেন ১০ কোটিরও বেশি টাকার স্কলারশিপ। তাঁর এই যাত্রা সংকট, সীমাবদ্ধতা আর সাহস একসাথে থাকলে অসম্ভব কিছুই নয়।
মাহাদীর শৈশব কেটেছে মালয়েশিয়ার কেলানতান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। বাবা-মা সে সময় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক হিসেবে কর্মরত থাকায় তিনি পেয়েছিলেন এক বহুজাতিক শিক্ষা পরিবেশ। সেখানে ভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে ইন্টারডিসিপ্লিনারি ভাবনা, সমাজ নিয়ে সচেতনতা এবং ক্যারিয়ার ফোকাস—সেটি তাঁর মনে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবার স্বপ্ন বুনে দেয়।
২০১৮ সালে দেশে ফিরে মাহাদী ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে। ভাষাগত চ্যালেঞ্জ ছিল ভয়ানক—বাংলায় কথা বলতে পারলেও লিখতে পারতেন না ঠিকভাবে। এরপর করোনার লকডাউনে চরম পরিশ্রম করে এনসিটিবি কারিকুলাম আয়ত্ত করেন। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি শেষে পরীক্ষা দেন সেনা পাবলিক স্কুল ও কলেজ (পূর্বে জিরাবো ক্যান্টনমেন্ট) থেকে।
এসএসসি শেষেই মাহাদী প্রথম বসেন SAT পরীক্ষায়। কোচিং না করে, শুধু খান একাডেমি, ইউটিউব, এবং সফলদের গাইডলাইন অনুসরণ করেই প্রস্তুতি নেন। IELTS না দিয়ে দেন ডুওলিংগো, যা তুলনামূলকভাবে সহজ, সাশ্রয়ী এবং অনেক সময় বাঁচায়।
কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে তখন, যখন তাঁর HSC রেজাল্ট পাওয়ার সময়কাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেডলাইনের পর পড়ে। তখন বাধ্য হয়ে GED পরীক্ষা দেন, যেটা আমেরিকান হাইস্কুল ডিপ্লোমার সমতুল্য। GED পরীক্ষায় ইংরেজি ও গণিতে ১৮০+ স্কোর করে পৌঁছে যান বিশ্বসেরার তালিকায় (Top 3 percentile globally)।
মাহাদীর মতে, এত বড় স্কলারশিপ পাওয়ার পেছনে মূলত তিনটি বিষয় কাজ করেছে—
১. সঠিক গাইডলাইন ও মেন্টরশিপ
২. একটি ব্যালান্সড এবং ওয়েল রাউন্ডেড প্রোফাইল
৩. দুঃসাহস এবং ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা
তিনি বলেন, “অনেকে ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকাটাই জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু আসলে দক্ষ হয়ে ওঠা এবং দেশের কাজে লাগা হওয়া উচিত মূল ‘বাংলাদেশি ড্রিম’। শুধু স্যাট বা GPA না, আমি চেষ্টা করেছি বিতর্ক, রোবোটিক্স, বিজনেস ফেস্ট, সেবামূলক সংগঠন, সব কিছুতেই অ্যাক্টিভ থাকা।”
তিনি ছিলেন জাতীয় টিভি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হওয়া দলের অংশ, মালয়েশিয়ায় স্টেট লেভেল মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় পদকপ্রাপ্ত, আবার নিজ কলেজে ক্যারিয়ার ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করেছেন। Essay-র প্রতিটি শব্দ নিয়ে করেছেন গবেষণা।
বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া—এটা কোনো সহজ কাজ নয়। কিন্তু মাহাদী তা দেখিয়েছেন। নিজে ইংরেজি ভাষা শিখেছেন প্যাসিভ উপায়ে—বই পড়ে, মুভি দেখে, ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে। তাঁর মতে, “স্পোকেন কোর্স আর কোচিং দিয়ে নয়, ভালো কনটেন্ট কনজিউম করে আর নিজের মত করে চর্চা করলেই ভাষা শেখা সম্ভব।”
তথ্য সংগ্রহে তিনি ফেসবুক, ইউটিউব, এমনকি পূর্ববর্তী সফলদের ইনবক্সেও দ্বারস্থ হয়েছেন। আবার অন্যদের সাহায্য করাও তাঁর এক ধরনের অভ্যাস হয়ে উঠেছে।
মাহাদী স্পষ্ট করে বলেন—“আপনি দরিদ্র হতে পারেন, কিন্তু স্বপ্ন দেখা যাবে না এমন নয়।”
তিনি বলেন, “NCTB বা বাংলা ভার্সন কোনো বাধা নয়, বরং এটাকে শক্তি বানান। আপনার লক্ষ্য হোক দক্ষতা অর্জন, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা নয়। GED, SAT, Duolingo—সব কিছু পাওয়া যায় যদি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়।”
তিনি আরও বলেন—"IELTS ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নেয়। দয়া করে ভুল গাইডলাইনে সময়, টাকা ও স্বপ্ন নষ্ট করবেন না।"
এই মুহূর্তে মাহাদী যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর গল্প বাংলাদেশের হাজারো তরুণের জন্য একটি আলোর রেখা, যারা হয়ত এখনো জানেই না তারা কতটা কিছু করতে পারে।
মাহাদী ইব্রাহিম কেবল একজন স্কলারশিপপ্রাপ্ত ছাত্র নন, বরং তিনি একজন তরুণ যোদ্ধা—যিনি ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, ও শিক্ষা ব্যবস্থার জটিলতা পেরিয়ে নিজের ‘বাংলাদেশি ড্রিম’ তৈরি করতে পেরেছেন।
সাব্বির