ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য

কারিমুন্নেছা হক

প্রকাশিত: ২০:১১, ১৪ জুন ২০২৫

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য

চামড়া দিয়ে তৈরি ছোট একটি পণ্যের মূল্যও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আর যারা একেবারেই জানে না চামরাজাত পণ্যের মূল্য কেমন তারা দরদাম শুনে হবেন কিছুটা বিস্মিত। অথচ অবাক করার বিষয় হলো এতো মূল্যবান পণ্যের কাচামালের উৎপাদন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ হওয়া সত্ত্বেও তা অবহেলিত হয় প্রায়ই। 
তথ্যানুযায়ী, এ বছর বেশিরভাগ গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০  থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ছোট চামড়ার দাম ৬০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। গত বছরও গরুর কাঁচা চামড়ার এ রকম দাম ছিল। এ ছাড়া এবার ছাগলের চামড়া প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা, যা গতবারও একই রকম ছিল। চলতি বছর কোরবানির ঈদের মৌসুমে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ট্যানারি মালিকরা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাখাওয়াত উল্লাহ বলেছেন, এ বছর  ছোট গরুর চামড়া বেশি। তবে সার্বিকভাবে চামড়ার সরবরাহ ভালো। তাঁদের হিসাবে, গত বছরের তুলনায় প্রতিটি চামড়ায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি। তিনি জানান, চলতি বছর ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো পাঁচ থেকে ছয় লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের অবদান ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময় বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া দেশের বাজারে আসে, যা পরবর্তী সময়ে প্রক্রিয়াজাত হয়ে রপ্তানি আয় বাড়ায় এবং লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার সংস্থান করে। এটি একটি শ্রমনির্ভর শিল্প হওয়ায় দেশের বেকার সমস্যা লাঘবেও ভূমিকা রাখে। কিন্তু এ শিল্প বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত, যার সমাধান এখন সময়ের দাবি।
একসময় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। কিন্তু পরিবেশদূষণ, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিকমান বজায় রাখতে ব্যর্থতা এবং ট্যানারি স্থানান্তর ঘিরে সৃষ্ট জটিলতা চামড়া শিল্পকে ক্রমেই পিছিয়ে দিচ্ছে। সাভারের ট্যানারি পল্লীতে এখনো পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। ফলে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, যার প্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানের ওপর। চামড়া সংগ্রহে মধ্যস্বত্বভোগীদের  দৌরাত্ম্য, কাঁচা চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, সংরক্ষণের অভাব ইত্যাদি কারণেও অনেক সময় চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো শিল্প। প্রতিবছর মোট চামড়ার ৬০ শতাংশ কোরবানির ঈদে আসে। তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করায় বিপুল পরিমাণ চামড়া ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়ার বড় ক্রেতা বর্তমানে চীন। তারা চামড়ার মূল্য কম দেয়।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মো. আবু ইউসুফ বলেছেন, ‘কোরবানির ঈদে একসঙ্গে প্রচুর চামড়া সরবরাহ হয়। যথাযথভাবে চামড়া সংরক্ষণ না করার কারণে মূল্য পান না অধিকাংশ ব্যবসায়ী। অন্যদিকে চামড়াশিল্পকে এখনো দূষণমুক্ত করা যায়নি। হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব করা গেলে বছরে ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব। সেটি হলে কোরবানির চামড়ার দাম এমনিতেই বেড়ে  যেত।’
উল্লেখ্য, রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্পকে দূষণমুক্ত পরিকল্পিত শিল্পনগরে স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। ২১ বছরেও এই চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। সাভারের হেমায়েতপুরের ২০০ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি (কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার) পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় পাশের ধলেশ্বরী নদী দূষণের শিকার হচ্ছে।
এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং আধুনিকায়ন। সাভারের ট্যানারি পল্লীতে অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিতকরণ এবং রপ্তানিমুখী প্রক্রিয়াজাত পণ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিতে হবে। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজনের নিরিখে এটি একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে চামড়া শিল্পকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করা সম্ভব। 

প্যানেল

×