
.
দেশের শিল্প খাতে গত কয়েক বছর ধরেই চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। উচ্চ মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা সম্ভব হয়নি। গত কয়েক মাসে এই সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে শিল্প মালিকরা আর কোনোভাবেই লস দিয়ে কারখানা চালু রাখতে চাচ্ছেন না। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ৩ দফা দাবি জানিয়েছে পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ৯টি বাণিজ্যিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) উদ্যোগে রবিবার রাজধানীর গুলশান ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এই দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএ প্রেসিডেন্ট শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গত এক থেকে দেড় মাস ধরে চলা প্রকট গ্যাস সংকটে দেশের রপ্তানি নির্ভর ও স্থানীয় টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক খাতসহ অনেক খাতের কারখানার উৎপাদন আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসের অভাবে ঠিক সময়ে উৎপাদন করতে না পারায় কার্যাদেশ অনুযায়ী সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছাতে বিমান ভাড়া করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বেড়ে কারখানাগুলোকে বিশাল অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে গত কয়েক বছরে দফায় দফায় ৩০০ শতাংশ অধিক মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। একইসঙ্গে মিল মালিকদের সিকিউরিটি বাবদ অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহের নামে মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও বাস্তবে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
তিনি বলেন, বিগত ৩ বছরেরও বেশি সময় এই খাতটি জ্বালানি সংকটের জন্য স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। বিগত কয়েক মাসে তীব্র গ্যাস সংকটে কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে সুতা, কাপড় ও পোশাকের উৎপাদন ব্যপকভাবে হ্রাস পেয়ে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সক্ষমতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। টেক্সটাইল খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের স্থানীয় বাজারও বিদেশীদের হাতে চলে যাচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতা ফিরে না পেলে আসন্ন ঈদ উৎসবে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস সময়মতো পরিশোধে সমস্যা তৈরি হবে। অপরদিকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকুচিত হওয়ায় অসহনীয় পরিস্থিতিতে শিল্প মালিকরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সমস্যার সম্মুখীন হবেন বলেও তিনি সতর্ক করে দেন।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে সমষ্যা দেখা যাচ্ছে এর অন্যতম প্রধান কারণ বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন বাড়াতে শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া। শুধু তিতাস নেটওয়ার্কেই শিল্প খাতে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমেছে বলে তিনি এসময় জানান।
গ্যাসের সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, রপ্তানি আয়ের মূল উৎসের প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। গ্যাসের এই অবস্থা চলতে থাকলে বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএর অধীনে টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। সংকট চলতে থাকলে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে রপ্তানি কমে যাবে। ফলে রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামষ্টিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হলে আর্থিক সংকট ঘনিভূত হবে, ব্যাংক ঋণ এবং শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে সংকট তৈরি হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে গেছে। গ্যাস-সংকটের কারণে ৬০ শতাংশের বেশি উৎপাদন হচ্ছে না কারখানায়। তিন মাস সুদ না দিলেই ঋণখেলাপি করছে ব্যাংক। আবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন পরিশোধের ধমক দিচ্ছে সরকার।
সংবাদ সম্মেলনে শিল্প খাতের ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণে সরকারের প্রতি ৩ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিল্প খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা, শিল্প খাত ও ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত ও এ বিষয়ে অংশীজনদের নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিযোগীশীল ও টেকসই মূল্য নির্ধারণ নীতিমালা তৈরি এবং বর্তমান গ্যাস সংকট মোকাবেলায় জরুরী পদক্ষেপ গ্রহন ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন।
প্যানেল