ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

শিল্পে জিঞ্জিরার সম্ভাবনা

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ২০:০৭, ৩ মে ২০২৫

শিল্পে জিঞ্জিরার সম্ভাবনা

মেড ইন জিঞ্জিরা বলতে আমাদের নাক সিটকানোর একটা প্রবণতা আছে। যে জাতি তার নিজের দেশের পণ্য গর্ব করে ব্যবহার করতে পারে না সে জাতি উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করতে পারে না। স্ব-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জিঞ্জিরা নামক শিল্প এলাকাটি অবহেলায় পড়ে আছে। জিঞ্জিরা বলতেই নকলপ্রবণ একটি শিল্পকে বুঝানো হয়। বাস্তব সত্য হলো জিঞ্জিরা খ্যাত কেরানীগঞ্জে নকল আছে সত্যি। যে কোনো বিদেশী ব্র্যান্ডেড পণ্য এই জিঞ্জিরায় অবিকলভাবে তৈরি করে বাজারজাত করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে যারা একটি আন্তর্জাতিকমানের পণ্য দেখে হুবহু সেই পণ্যটির নকল তৈরি করতে পারে, তারা নিশ্চয়ই প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা পেলে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারবে। এই জিঞ্জিরাকে শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট। তারপরও আমাদের সরকার নীরব কেন?
আমরা জানি-  চীন যে একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ তা অনুধাবন করা গিয়েছিল সত্তরের দশকে। তখন থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা এ চারটি মৌলিক বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল। এটাই চায়না শিল্পবিপ্লবের অন্যতম ভিত্তি মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা বাস করে চীনে। চীন পৃথিবীর মধ্যে একটি বড় দেশ। যেটা প্রতিবেশী ভারত থেকে তিনগুণ বড় এবং সাতাত্তর গুণ বড় বাংলাদেশ থেকে। চীনের জনসংখ্যা প্রায় পঞ্চান্নটি জাতি-গোষ্ঠীতে বিভক্ত। চীন পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার দেশ। চীনের সভ্যতা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বত্র আলো ছড়িয়েছে। বিশেষ করে জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোচীনে সর্বত্রই এর প্রভাব প্রতিফলিত। কিন্তু নব্বই এর দশকের আগে চীনের এসকল সাফল্য খুব বেশি আলোচিত হয়নি। কিছুদিন আগেও চীনের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল ২৬০ ইউএস ডলারের সমান। কিন্তু অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পর এই আয় নাটকীয়ভাবে বাড়তে থাকে। তা এখন মাথাপিছু প্রায় ১০০০ ইউএস ডলারের সমান। এ ধারা প্রতিদিন বেড়ে চলছে।
আশির দশক থেকে চীনে ছোট ছোট ব্যবসাবাণিজ্য ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে বাজার অর্থনীতির দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। সঙ্গে চীন তার বাজার উš§ুক্ত করে দেয় বিদেশী পুঁজি ও টেকনোলজির জন্য। বিদেশী বিনিয়োগের জন্য বিশেষ কিছু শিল্প এলাকা তৈরি করে দেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা চীনকে একটি কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে শিল্পনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করে। শিল্পে এই সফলতার ফলে ১৫ বছর দরকষাকষির পর ২০০১ সালে চীন হয়ে যায় ডব্লিউটিও এর সদস্য। ডব্লিউটিওর সদস্য হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক করে। আমেরিকার কংগ্রেস একটি বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাষ্ট্র হিসেবে চীনকে স্বীকার করে নেয়।
বিশ্বায়ন ও শুল্কমুক্ত ধারণার ফলে বহির্বিশ্বে চীনের পণ্যের জন্য এক বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কম দাম, গ্রহণযোগ্য মান, পণ্যের বৈচিত্র্য, আকর্ষণীয় প্যাকিং বিশ্ব বাজারে চীনের পণ্যকে গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করেছে। তার জন্য বিশ্ববাজারে চীন এখন একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রাধান্য বিস্তার করেছে। বিশ্বে চীন এখন সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত। বর্তমান ধারায় উন্নয়ন যদি অব্যাহত থাকে, তবে ২০২০ সালের মধ্যে চীনে তৈরি হবে হাজার হাজার মাল্টি মিলিয়নার। ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন হবে এমন শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ, যে দেশটি বিশ্বের ৩০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে।
বিশ্ব পণ্যবাজারে চীনের বিস্তৃতি এখন ‘ফুটওয়্যার  থেকে আন্ডারওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার থেকে সফটওয়্যার পর্যন্ত’। বিশ্ব পুঁজি বাজারেও চীনের এখন দোর্দণ্ড প্রতাপ। চীনের অগ্রগতি সম্পর্কে একজন প্রবাসী সাংবাদিক একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছেন- ‘২৫ বছর ধরে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৯ শতাংশ হারে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পক্ষেই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়নি। এই ২৫ বছরে চীনের অর্থনীতি বেড়েছে ৮ গুণ। যদি এই হারে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে, তবে ২০৩৫-৪০ সাল নাগাদ চীনের অর্থনীতি তার আকারের দিক দিয়ে আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
আসা যাক আমাদের কেরানীগঞ্জের কথায়। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬০-এর দশকের শেষদিকে জীবিকার সন্ধানে ফরিদপুর থেকে কিছু লোক এসে বসবাস শুরু করে বুড়িগঙ্গার তীরে এই কেরানীগঞ্জে। ধীরে ধীরে এখানে যুক্ত হয় কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী এলাকার কতিপয় উদ্যোক্তা। তারপর কালপরিক্রমায় মুখরিত হয়ে উঠে এই জিঞ্জিরা। এই জিঞ্জিরা নকল জিনিস তৈরির সুতিকাগার বলে পরিচিত হলেও এখানে আসল ও নকল উভয় ধরনের জিনিসই তৈরি হয় বলে জানা গেছে। জিঞ্জিরার এসব শিল্পজাত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। কর্মসংস্থান হয়েছে অসংখ্যা মানুষের। এখানে শুধু দেখে নিজের কল্পনা শক্তির ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয় নকল সামগ্রী। এসব স্ব-শিক্ষিত মেধাবী জনশক্তির কর্ম নিপুণতা দেখলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। কল্পনা করা যায়, এসব মেধাকে আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার আওতায় এনে জিঞ্জিরাকে শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়ে দেশীয় পণ্য উৎপাদনের বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। স্বদেশি পণ্যে স্বনির্ভরতা আর কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে এমন উদ্যোগ মাইলফলক ভূমিকা রাখবে।
কেরানীগঞ্জ শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। জিঞ্জিরা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রসাধনসামগ্রী থেকে শুরু করে বাইসাইকেল, হাজারো খেলনা, চামড়া-প্লাস্টিকের জুতা-স্যান্ডেল, সিরামিকের তৈজসপত্র, আলকাতরা, নারিকেল, তেল, শাড়ি-লুঙ্গির জন্যও এখন প্রসিদ্ধ। এখানকার কারিগররা মাত্র ২০/৩০ হাজার টাকা মূল্যের যন্ত্রে প্লেনশিট থেকে যে মানের  ঢেউ টিন তৈরি করেন। জিঞ্জিরায় দুই হাজারের  বেশি ক্ষুদ্র এবং হালকা শিল্প কারখানা। ১২ লাখ কারিগর-শ্রমিকের খুটখাট, টুংটাং, ঢং-ঢং। এখানকার মানুষ তাদের এই এলাকাকে সরল অহমিকায় বলে ‘বাংলার চীন’, ‘বাংলার জাপান’, ‘মেইড ইন জিনজিরা’। এখানে বড় বিপ্লব ঘটেছে  পোশাক শিল্পে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ পোশাকের ৬০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে এই পল্লী। এখানে দিনে বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার পোশাক। বিশেষ করে জিন্স প্যান্ট তৈরিতে সুনাম অর্জন করেছে। দেশীয় বাজারের জিন্সের প্রায় ৮৫ ভাগ চাহিদা কালীগঞ্জ থেকে পূরণ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ ৩৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এখানকার তৈরি পোশাক।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাব, মূলধনের স্বল্পতা, কাঁচামালের অভাব এবং ভারতীয় পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়ার কারণে কেরানীগঞ্জের মতো সম্ভাবনাময় শিল্প এলাকা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি পাওয়ার প্রেস ভারত থেকে আমদানি করতে প্রয়োজন হয় ৭-৮ লাখ টাকা। অথচ এই জিঞ্জিরায় দেশীয় প্রযুক্তিতে যে পাওয়ার প্রেস তৈরি করা হয় তার দাম পড়ে মাত্র ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। জিঞ্জিরায় এখন তৈরি হয় উন্নতমানের সামগ্রী। এখানকার উৎপাদিত পণ্য দেশীয় চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি হয় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মিয়ানমারে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো দরকার।

প্যানেল

×