
বান্দরবানের শৈলপ্রপাতে নাফিস
বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। হাওড়-বাঁওড়, নদী, নালা, খাল, বিলে ভরা এ দেশ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ পর্যটন স্পটগুলো। স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটন আকর্ষণে যে বৈচিত্র্য তা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। এ দেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত-কক্সবাজার, পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল-সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা-কুয়াকাটা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভূমি সিলেট, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আচার-অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভূমি ঘেরা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো।
ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। পর্যটন শিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মডেল হতে পারে। সমুদ্র বেষ্টিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনারগাঁ, সিলেটের জাফলং, মাধবকুণ্ড, হামহাম বা শেরপুরের ঝিনাইগাতি, নকলা বা গজনী আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয়ভাবে জায়গাগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থানগুলোর পর্যটন সুবিধা নিশ্চিত করে এই শিল্পের আরও বিকাশ করা যেতে পারে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ববাহী শিল্প বিকাশের অন্যতম শর্ত সে দেশের প্রশান্ত পরিবেশ। বর্তমানে পৃথিবীর ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে ১টি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে।
মানুষের ব্যস্ততা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে, তাই একটু প্রশান্তির জন্য কেউ ছুটে যান প্রকৃতি ঘেঁষা সৌন্দর্যের খোঁজে। আবার কেউ যান বিলাসী কোনো রিসোর্টে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তথ্যানুযায়ী, বিগত ৭০ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পরিধিও ব্যাপকতা লাভ করেছে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১০ সালে একটি যুগোপযোগী ‘পর্যটন উন্নয়ন নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী, গত এক যুগ ধরে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ২৫টি পর্যটন সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। এর মাধ্যমে দিনাজপুর, কুয়াকাটা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, রাঙ্গামাটি, সিলেটের জাফলং ও লালাখাল এবং সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের কাজীপুর, ঢাকার অদূরে গাজীপুরের সালনায় পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন ও উন্নয়ন করা হয়েছে।
বর্তমানে পর্যটন খাত বৈশ্বিক জিডিপিতে প্রায় ১১ শতাংশ অবদান রাখছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে বা মোট দেশজ উৎপাদনে এ শিল্পের অবদান ৩ দশমিক ০২ শতাংশ। ২০৪১ সালের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের এই অবদান দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নয়নাভিরাম এ দেশের প্রতিটি গ্রামকেই পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করা সম্ভব। এজন্য প্রতিটি এলাকায় উপযুক্ত পর্যটন অবকাঠামো এবং নিরাপদ খাবার ও আবাসনের ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন। একইসঙ্গে প্রশিক্ষিত ও বিশেষভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত ট্যুর গাইডিং কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হলে অভ্যন্তরীণ পর্যটন ব্যাপকভাবে বিকশিত হবে। দেশে ১ হাজার ৫২৯টি পর্যটনকেন্দ্র চিহ্নিত। এর মধ্যে হয়তো ৫০টি কেন্দ্র মানুষের কাছে পরিচিত।
এ কেন্দ্রগুলোকে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে উন্নয়ন করা জরুরি। দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার জেলার আয়তন প্রায় ২৫০০ বর্গ কিলোমিটার হলেও প্রায় ৯০ ভাগ পর্যটন স্থাপনা এই জেলার মূল শহর ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি ইনানীভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র পর্যটন জোন তৈরি হয়েছে। কিন্তু একে পরিকল্পনা, সমন্বয় ও পরিবেশ-বান্ধব স্থাপনানির্মাণ নীতির আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
বিশ্বে পর্যটনশিল্পকে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত করতে উত্তম যোগাযোগব্যবস্থা, আইনের শাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, থাকা-খাওয়ার উন্নত ব্যবস্থা, বৈচিত্র্যময় বিনোদন সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে যে হারে পর্যটনশিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে না এই শিল্পে কাজ করার মতো দক্ষ জনবল। ফলে দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দরকার। আগামী কয়েক বছরে হোটেল ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৩০ হাজার জনবলের প্রয়োজন হবে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবা খাতে ১১ জন মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় আরও ৩৩ জনের। ১ লাখ পর্যটকের আগমনের সঙ্গে ১১ লাখ কর্মসংস্থান যুক্ত।
কোনো স্থাানে যদি ১০ লাখ নিয়মিত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটক থাকে, সেখানে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয় ১ কোটি ১০ লাখ। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এটি আরও ব্যাপক হতে পারে। কারণ এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই হচ্ছে তরুণ ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। স্বল্প বিনিয়োগে অধিক লাভ এনে দেওয়া পর্যটনশিল্প পৃথিবীজুড়ে চলতি দশকের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে। মালয়েশিয়ার জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটনশিল্প বছরে অবদান রাখছে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার। নেপালের জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশের উৎস পর্যটন খাত। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫, তাইওয়ানের ৬৫, হংকংয়ের ৫৫ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান।
জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে যে ১৭টি লক্ষ্যের কথা বলেছে, তার মধ্যে ৮, ১২ ও ১৪ নম্বর সরাসরি পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ১৪টিও কোনো না কোনোভাবে পর্যটনসংশ্লিষ্ট। তাই এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পর্যটনের বিকাশ দারুণ সহায়কের ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৩ লাখ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ হলেও আয়তন অনুপাতে ব্যাপক বৈচিত্র্যময় ৭০০ ছোটবড় নদীর এই দেশ নদীর জন্যই পরিচিত হতে পারতো বিদেশী পর্যটকদের কাছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা অভাব ও দুর্নীতির ভয়াল গ্রাসে গাছপালা সমৃদ্ধ প্রকৃতি এবং নদ-নদী অনেককিছুই বিলুপ্তির পথে। দেশ ও জাতির উন্নয়নের স্বার্থে এ পরিস্থিতির উত্তরণ প্রয়োজন। পর্যটন স্পটের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে মোট দেশজ আয় বাড়ানোর রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।