ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মৎস্য খাতে বিনিয়োগ অপরিহার্য

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ০০:২৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

মৎস্য খাতে বিনিয়োগ অপরিহার্য

.

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান অসস্বিকার্য়। বিশেষত মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, রফতানি বাণিজ্যের প্রসার সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ ব্যাপারে সরকারের সময়োপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক নীতি গ্রহণ, মৎস্য গবেষণার উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণসহ নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং চাষী ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক কারিগরি পরিষেবা প্রদানের কারণে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ জোগান দিচ্ছে মাছ।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে মানুষ এখন ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এখন মৎস্য খাতের অবদান। বিগত ১২ বছরে মৎস্য খাতে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ১ লাখ টন যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ১ লাখ টন। এর মধ্যে সামুদ্রিক মাছের অবদান ৬ দশমিক ৮১ লাখ টন যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। মাছ ও মাছ জাতীয় পণ্যের রফতানির পরিমাণ মোট রফতানি আয়ের ১ দশমকি ৩৯ শতাংশ। বার্ষিক মৎস্য দরদামের স্থিতিশীলতাই বলে দেয় মৎস্য চাষে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ যদিও কোন কোন মাছ দেশে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশের ইলিশ’ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই সনদ লাভ করেছে। বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য। বর্তমানে বিশ্বের ৫২টি দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএসএ, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের মাছ ও মাছ জাতীয় পণ্য রফতানি হচ্ছে। বর্তমানে ১০৫টি মৎস্য প্রক্রিয়াজাত প্লান্টকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩টি ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানির জন্য অনুমোদিত। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ হিমায়িত ও তাজা মাছ রফতানি করে ৪৭৭ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

গত কয়েক দশকে চাষ করা মাছ এবং এক দশকে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনুকরণীয়। কিন্তু নদীর নাব্য হ্রাস, দূষণ, হাওড়-বাঁওড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর সংকোচন, দখল, অপ-উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ার মতো ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে মাছ ধরা এবং চাষের সঙ্গে জড়িত বিপুল পেশাজীবীর আর্থিক ও পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও উপেক্ষিত, যা এই অগ্রগতিকে হুমকিতে ফেলতে পারে। দেশে এখন প্রায় চার কোটি লোক মৎস্য খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। লাভজনক হওয়ায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত মানুষ ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান মৎস্য চাষে এগিয়ে এসেছে। হাওড়-বাঁওড়, অন্যান্য জলাশয় ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, দূষণ রোধ এবং জাতীয় আয়ে মৎস্য খাতের বিপুল অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। তবেই এ অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব। পৃথিবীর প্রায় ৫২টি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিএফআরআই সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে কার্প, অর্থাৎ রুই জাতীয় মাছ ২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় রুই মাছ, ১১ শতাংশ। এরপরে রয়েছে পাঙাশ (১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ), তেলাপিয়া (৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ), কাতলা (পৌনে ৭ শতাংশ) ও সিলভার কার্প (৭ দশমিক ৩ শতাংশ)। গত এক যুগে দেশী ৩৬ প্রজাতির ছোট মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে চাষের মাছ উৎপাদন ৬৭ হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে স্বাদু পানির ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০টি প্রজাতির চাষ বেশি হচ্ছে। বাকিগুলোর চাষ বাড়লে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত ১৫- ১৬ বছরে এ খাতে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকে। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদের ১ শতাংশও ধরতে পারছে না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে, সে ব্যাপারেও কোন তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রফতানির মাধ্যমে অনায়সেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়।

এ ছাড়া মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব। সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য বিদেশী বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে হবে, দেশীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে। সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎষ্য পরামর্শ কেন্দ্র চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়। আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘণ্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে।

উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভাল। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মিয়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপির মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডাটাবেস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারী নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে।

 

×