
গোপালগঞ্জের বলাকইড় পদ্মবিলে প্রকৃতি ও সৌন্দর্যপ্রেমীদের ঘোরাঘুরি
অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে প্রকৃতি ও ভ্রমণ পিপাসুদের আকৃষ্ট করছে গোপালগঞ্জ জলজ ফুলের রানী পদ্মফুল। যার অপার সৌন্দর্য ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না- দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়, দূর হয়ে যায় সব দুঃখ-কষ্ট। মন হারিয়ে যায় প্রকৃতির মাঝে। সূর্য উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজ রূপের দ্যুতি ছড়াতে শুরু করে পদ্মরানী। জলের তলায় পাঁকের মধ্য থেকে ওপরে উঠে আসা কণ্টকযুক্ত মৃণালের অগ্রভাগে ¯িœগ্ধ-কোমল কলি ভেদ করে ৬৪টি পাঁপড়ি মেলে নিজের সৌন্দর্যের কথা জানান দেয় প্রকৃতিকে। ফুল ফুটলেই চারদিকে ছড়ায় মিষ্টি গন্ধ। স্বাগত জানায় প্রকৃতিপ্রেমীদের। এলোমেলো বাতাসের তালে তালে দোল খেয়ে সাদা ও গোলাপি আভা ছড়িয়ে দেয় পদ্মবিলের স্বচ্ছ জল ও আশপাশের প্রকৃতির মাঝে।
দেখা মেলে পদ্মফুলের ওপর মৌমাছি ভ্রমরের নাচানাচি, দেখা মেলে পদ্মপাতার ওপর জলকণার খেলা, দেখা মেলে সোনালি ব্যাঙ আর ঘাস-ফড়িংয়ের দৌড়ঝাঁপ, দেখা মেলে সাপের এঁকেবেঁকে চলা। প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যের সবটুকু ঢেলে দেয় পদ্মপাতায়। আর তাই, বছরের এই সময়টাতে ইট-পাথরের যান্ত্রিক জীবনে খানিকটা স্বস্তির নিশ^াস আর প্রকৃতির স্বাদ নিতেই পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সবাই ছুটে যায় ওই পদ্মবিলে। নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আর প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করে অনাবিল আনন্দে সবাই উপভোগ করেন পদ্মবিলের অপরূপ সৌন্দর্য।
আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকার বিলে প্রস্ফুটিত হয় এই পদ্মরানী। এরমধ্যে বলাকইড় পদ্মবিলটিই অপেক্ষাকৃত বড় এবং প্রায় ২শ’ একর এলাকা জুড়ে ফোটে এই পদ্মফুল। তাই এখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা ও প্রাণবন্ত- অনুভূতিটাও অন্যরকম। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলারই একটি বিলবেষ্টিত গ্রাম বলাকইড়।
জেলা শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। ১৯৮৮’র বন্যার পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবেই এ বিলের অধিকাংশ স্থানে পদ্মফুল জন্মাতে শুরু করে। বছরের এই সময়টাতে বিলের গোটা এলাকাই ভরে ওঠে সাদা ও গোলাপি পদ্মে। ওপরে নীল আকাশ আর নিচে স্বচ্ছ জলরাশি জুড়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে দেয় ফুটে থাকা রাশি রাশি পদ্ম। আর তাই ক্রমেই এই পদ্মবিলটির পরিচিতি বেড়েছে এবং প্রকৃতি ও সৌন্দর্যপ্রেমীদেরও আগমন বেড়েছে।
পাশাপাশি এ এলাকার কাজ না থাকা কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে। আগত দর্শনার্থীদের পদ্মবিলে নৌকায় ঘুরিয়ে তারাও কিছু উপার্জনের পথ খুঁজে পেয়েছে। পদ্মবিলের সৌন্দর্য ধরে রাখাসহ পদ্ম যাতে চুরি হয়ে না যায়, সেজন্য তারা নিজেরাই ব্যবস্থা নিয়েছে। দিনে-রাতে নিজেরাই পালাক্রমে পাহাড়া দিচ্ছেন। ছুটির দিনগুলোতে সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। তবে ভিড় জমলে সেখানকার মাঝি-মাল্লাদের পারিশ্রমিকের পরিমাণও বেড়ে যায় বলে অভিযোগও রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে এলাকার লোকজন সেখানকার সড়কটি প্রশস্তকরণসহ একটি মৌসুমি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এই পদ্মবিলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও মানুষের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। সুযোগ পেলেই দূর-দূরান্ত থেকে প্রকৃতি ও সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে ছুটে আসছেন। পদ্মবিলের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছেন যে যার গন্তব্যে। পদ্মরানীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে আসা জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিবেদিতা রায় জুঁই তার অনভূতি ব্যক্ত করে জনকণ্ঠকে বলেছেন, বলাকইড় পদ্মবিলে এসে প্রকৃতির সঙ্গে সাহিত্যের অবিচ্ছিন্ন বন্ধন অনুভব করছিলাম।
নিজেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বরুণা কল্পনা করতে করতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছি। মাথায় আর মনে ঘুরেফিরে একটাই লাইন আসছিল, ‘যেখানে পদ্ম ফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে!’ গোলাপি পদ্ম দেখে মনে হয়েছে বিলের কিংবা ঝিলের জলে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে বাতাসের তালে তালে হাল্কা দুলে দুলে ‘পদ্মরানী’ যেন তার রাজ্যে শাসন করছে।
প্রকৃতির সবকিছু যখন নিজস্বতা হারাচ্ছে, পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, তখন পদ্মবিলে পাঁকের জলে সাপ আর শ্যাওলার মাঝে পদ্মপাতা নিজের বিশুদ্ধতার আঁচল ছড়িয়ে আছে। আর সেই আঁচলে সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে পদ্মফুল ফুটেছে। আরেক সৌন্দর্যপিপাসু ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক স্মৃতি রায় জনকণ্ঠকে বলেছেন, সবুজ শ্যামল এই বাংলাদেশের অন্যতম প্রকৃতির লীলাভূমি এই বলাকইড় পদ্মবিল। এখানের সৌন্দর্য এমনই, যেখানে সবুজের মাঝে যেন গোলাপি বিছানা! সকালের স্নিগ্ধতা আর সৃষ্টির অপরূপ, উদার সৌন্দর্য এই পদ্মবিল আমাকে করেছে মোহিত এবং সেইসঙ্গে আমি গর্বিতও বটে। তার সঙ্গে আরেকটি মাত্রা যোগ হয়েছিল দুই বন্ধুসহ সবার পরিবার। কিন্তু আরও সময় পদ্ম ও প্রকৃতির সঙ্গে থাকতে চাইলেও বাস্তবতা সেটা সমর্থন করেনি।